CONTENTS অর্জুন
সৈন্যবাহিনী পর্যবেক্ষণ করতে চান অর্জুন
যুদ্ধের ভয়াবহতা বর্ণনা করলেন অর্জুন
যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বললেন ভগবান
কৃষ্ণ অর্জুনকে যোদ্ধা হিসাবে তার দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিলেন কর্মযোগের
গুরুত্ব, নিঃস্বার্থ
সেবা বেদ
জীবনের পার্থিব এবং আধ্যাত্মিক উভয় দিক নিয়ে কথা বলে ইন্দ্রিয়
নিয়ন্ত্রণ এবং আত্মজ্ঞানের মাধ্যমে শান্তি এবং আনন্দ প্রাপ্তি স্রষ্টার
প্রথম আদেশ একে অপরকে সাহায্য করা নেতাদের
উদাহরণ স্থাপন করা উচিৎ 4. জ্ঞানের সাহায্যে আত্মত্যাগের পথ সংযুক্ত, বিচ্ছিন্ন, এবং নিষিদ্ধ
ক্রিয়া কর্মযোগী
কর্মফলের নিয়মে আবদ্ধ নন বিভিন্ন
ধরণের আধ্যাত্মিক অভ্যাস অতীন্দ্রিয়
জ্ঞান প্রাপ্ত করা শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক অভ্যাস অতীন্দ্রিয়
জ্ঞান স্বয়ংক্রিয়ভাবে একজন কর্মযোগীর কাছে প্রকাশিত হয় নির্বাণের
জন্য উভয় অতীন্দ্রিয় জ্ঞান এবং কর্মযোগ প্রয়োজন একজন কর্মযোগী
ঈশ্বরের কাজ করেন জ্ঞানী
ব্যক্তির অতিরিক্ত লক্ষণ তৃতীয় পথ
--- ভক্তিপূর্ণ ধ্যান এবং মননের পথ মনকে
নিয়ন্ত্রণ করার দুটি পদ্ধতি বস্তু, চেতনা, এবং আত্মার
সংজ্ঞা ভগবানকে
পুজো করার জন্য যেকোনো পছন্দসই রূপে দেখা যায় পরমাত্মা, আত্মা, জীবাত্মা এবং
কর্মফলের সংজ্ঞা ঈশ্বরকে
উপলব্ধি করার সরল পদ্ধতি মৃত্যুর
সময়ে ভগবানের চিন্তায় মনস্থির করে মুক্তি পান পরমাত্মার
প্রকৃতির জ্ঞান সবচেয়ে বড় রহস্য ভক্তি
প্রেম দ্বারা মোক্ষ প্রাপ্তি প্রভু
ভালোবাসা এবং নিষ্ঠার নৈবেদ্য গ্রহণ করেন ভগবান
তাঁর ভক্তদের জ্ঞান প্রদান করেন বাস্তবের
প্রকৃত প্রকৃতি কেউ জানতে পারেনা দৈব
আবির্ভাবের একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা অবতার
সৃষ্টি পরমেশ্বরের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র ঈশ্বরের
দর্শন পাওয়া ভক্তের জন্য পরম লক্ষ্য প্রভু
কৃষ্ণ নিজের বিশ্বরূপ দর্শন করালেন মানুষ
ভগবানকে দেখতে প্রস্তুত এবং যোগ্যতাসম্পন্ন নয় অর্জুন বিশ্বরূপ দর্শনে ভীত হলেন আমরা শুধুমাত্র
স্বর্গীয় যন্ত্র বিশ্বরূপের
কাছে অর্জুনের প্রার্থনা আপনি
যেকোনো রূপে ভগবানকে দেখতে পারেন ভগবানকে
ভক্তিপ্রেমের মাধ্যমেই দেখা যায় ব্যক্তিগত
না নৈর্ব্যক্তিক ভগবানের উপাসনা করা উচিৎ ঈশ্বরের
ব্যক্তিগত রূপ উপাসনা করার কারণ মানুষের
অকপটভাবে স্বর্গীয় বৈশিষ্ট্যগুলির বিকাশ করা উচিৎ নির্বাণের
পথ হিসাবে রাখা চারটি মহান সত্য ভগবানকে
শুধুমাত্র দৃষ্টান্ত দিয়ে বর্ণনা করা যায় এবং আর কোন ভাবে নয় পরমাত্মা, আত্মা, জড় প্রকৃতি,
এবং জীবাত্মা শুধুমাত্র বিশ্বাস দ্বারা নির্বাণ প্রাপ্ত করা যায় সমস্ত
প্রাণী বস্তু এবং আত্মার মিলনে জন্মগ্রহণ করে কিভাবে
জড় প্রকৃতির তিন গুন শরীরের সঙ্গে আত্মার বন্ধন স্থাপন করে এই তিনটি
গুণ জীবাত্মার স্থানান্তরে যাওয়ার যান জড়
প্রকৃতির তিনটি গুন অতিক্রম করার পরে নির্বাণ লাভ করুন এই তিন
গুণকে অতিক্রম করার পদ্ধতি ভক্তিপ্রেম
দ্বারা তিন গুণের বন্ধন মুক্ত করা যায় সৃষ্টি
একটি বৃক্ষ যা মায়ার ক্ষমতায় সৃষ্ট কিভাবে
আসক্তির বৃক্ষচ্ছেদ করা যায় এবং মুক্তি পাওয়া যায় পরমাত্মা, আত্মা এবং সৃষ্ট প্রাণীকুল কি কি? মুক্তির
জন্য যে প্রধান স্বর্গীয় গুণাবলীগুলির চর্চা করা উচিৎ আসুরিক
প্রবৃত্তির তালিকা যা পরিত্যাগ করা উচিৎ দুই
ধরণের মানুষ আছে: জ্ঞানী এবং অজ্ঞ মানসিক, বাচিক, এবং কায়িক
তপস্যা 18. অহং ত্যাগ করে মোক্ষ প্রাপ্তি করা তিন ধরণের ধৃতি এবং চার ধরণের মনুষ্য জীবনের লক্ষ্য শ্রমের
বিভাজন একের দক্ষতার উপর নির্ভরশীল কর্তব্য, শৃঙ্খলা, এবং ভক্তির
মাধ্যমে মুক্তি প্রাপ্ত করা কর্মফলের
বন্ধন এবং স্বাধীন ইচ্ছা সমর্পণের
পথ, ভগবানের
কাছে যাওয়ার চরম পথ ভগবানের
জন্য করা সর্বোচ্চ সেবা, এবং
সবচেয়ে ভালো দান ভগবৎ-গীতা শ্লোকগুলি (বাংলায় ভগবদ-গীতার শ্লোক)
(English Translation by IGS) 1.অর্জুনের
দ্বিধা রাজা
ধৃতরাষ্ট্র বললেন: হে সঞ্জয়, কুরুক্ষেত্রের পুণ্যভূমিতে যুদ্ধের জন্য উন্মুখ হয়ে একত্রিত হয়ে, আমার
পুত্রেরা এবং পাণ্ডবেরা কি করল? (1.01) সঞ্জয় বললেন: পাণ্ডব সৈন্যদের ব্যূহ রচনা দেখে, রাজা দুর্যোধন তার
গুরুর কাছে গিয়ে বললেন:
(1.02) হে প্রভু, পাণ্ডুপুত্রদের
এই মহান সৈন্যদল দেখুন, যা দিয়ে
আপনার অন্য প্রতিভাশালী শিষ্য ব্যূহ রচনা করেছেন। এদের মধ্যে অনেক মহান যোদ্ধা,
রথী, মহারথী, এবং মহান ধনুর্ধর আছেন। তাদের মধ্যে কিছুজনের নাম আমি আপনাকে বলবো। (1.03-06) এছাড়াও, আমাদের
মধ্যে যে সমস্ত বিশিষ্ট জনেরা আছেন, সেই সব নরোত্তমের কথাও জানুন। আমি সেই
সমস্ত সেনাপতি এবং যেসমস্ত সেনানায়ক আমার জন্য তাদের জীবন বিপন্ন করছেন তাদের কথাও
বলবো। তাড়া বহু যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত, এবং বহু রণকৌশলে পারদর্শী। (1.07-09) আমাদের সৈন্য
অজেয়, যেখানে তাদের সৈন্যদের হারিয়ে দেওয়া সহজ। তাই, ব্যূহের অগ্রে যারা স্থান
অধিকার করে আছেন, আমাদের সেনাপতি ভীষ্মকে রক্ষা করুন। (1.10-11) মহান ভীষ্ম,
কুরু বংশের সর্ববৃদ্ধ ব্যক্তি, সিংহের মতো গর্জন করে নিজের যুদ্ধ শঙ্খ ধ্বনিত করলেন, যা
দুর্যোধনকে যারপরনাই আনন্দিত করে তুললো। (1.12) তারপর, শঙ্খ, ভেরী, পণব, আনক, ঢাক এবং
গোমুখ শিঙা প্রভৃতি একসাথে বেজে উঠলো। তুমুল
শব্দ সৃষ্টি হল। (1.13) শ্বেতঅশ্বের
মহান রথে বসে ভগবান কৃষ্ণ এবং অর্জুন তখন তাদের দিব্য শঙ্খগুলি বাজালেন। (1.14) কৃষ্ণ নিজের শঙ্খ
বাজালেন; তারপর
অর্জুন এবং সেনার অন্যান্য বিভাগের সেনাধিপতিরা নিজ নিজ শঙ্খে ফু দিলেন। এই
প্রচণ্ড শব্দ, আকাশ এবং ধরিত্রী ভেদ করে ধ্বনিত হল, কৌরবদের হৃদয় বিদীর্ণ করে। (1.15-19) অর্জুন সৈন্যবাহিনী পর্যবেক্ষণ করতে চান অস্ত্র
প্রয়োগের মাধ্যমে যুদ্ধ যখন শুরু হতে চলেছে, প্রভু হনুমানের চিহ্ন দেওয়া পতাকায়
সজ্জিত হয়ে অর্জুন যখন যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত কৌরবদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন, তিনি
নিজের শরধনু তুলে নিয়ে ভগবান কৃষ্ণ কে বললেন: হে প্রভু, আমার রথ দুই
সৈন্যের মাঝখানে নিয়ে চলুন যাতে আমি দেখতে পাই কারা যুদ্ধ করার আকাঙ্ক্ষায় এখানে
এসেছে এবং কাদের সঙ্গে আমাকে যুদ্ধ করতে হবে। (1.20-22) আমি দেখতে চাই কারা দুর্বুদ্ধিসম্পন্ন
কৌরবদের হয়ে এবং তাদেরকে খুশী করতে যুদ্ধ করার জন্য এখানে সমবেত হয়েছে। (1.23) সঞ্জয় বললেন: হে রাজন,
অর্জুনের অনুরোধে ভগবান কৃষ্ণ সেই সর্বোত্তম রথ দুই সৈন্যের মাঝখানে ভীষ্ম, দ্রোণ,
এবং অন্যান্য রাজাগণের সম্মুখে নিয়ে গেলেন, এবং অর্জুনকে বললেন: এই দেখ সমস্ত
একত্রিত কৌরবদের!
(1.24-25) সেখানে অর্জুন দেখলেন নিজের পিতৃতুল্য, পিতৃব্যতুল্য, গুরু,
মাতুল, ভাই, পুত্র, এবং বন্ধুদের। (1.26) দুই
সৈন্যবাহিনীতে, নিজের পিতৃতুল্য, সঙ্গী, এবং সমস্ত রাজন্যবর্গকে দেখে অর্জুন
কৃপাপরবশ এবং বিষণ্ণ হলেন ও বললেন: হে কৃষ্ণ, আমার আত্মীয়স্বজনকে যুদ্ধাভিলাষী দেখে আমার
হাত-পা অবশ লাগছে, মুখ শুকিয়ে আসছে। আমার শরীর কাঁপছে, চুল খাড়া হয়ে উঠেছে। (1.27-29) ধনু হাত থেকে পড়ে
যাচ্ছে, এবং মনে হচ্ছে ত্বক পুড়ে যাচ্ছে। আমার মাথা ঘুরছে, আমি সজা হয়ে দাঁড়াতে
পারছিনা, হে কৃষ্ণ, আমি চারিদিকে খালি অমঙ্গলের চিহ্ন দেখছি। আমার স্বজনকে যুদ্ধে
হত্যা করার কোন কারণ দেখিনা। (1.30-31) আমি জয় চাইনা, আমার রাজ্যসুখ চাইনা, হে কৃষ্ণ। রাজ্যপাট,
সুখ, এবং এমনকি জীবনের কি প্রয়োজন, হে কৃষ্ণ? কারণ তারা --- যাদের জন্য আমরা রাজ্য, সুখ, এবং আনন্দ খুঁজি --- তাড়া সকলেই এই
যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে, তাদের জীবন এবং সম্পদের আশা পরিত্যাগ করে। (1.32-33) হে কৃষ্ণ, এই
পার্থিব রাজ্য কেন, এমনকি ত্রিলোকের সমস্ত রাজত্বের জন্য আমি আমার গুরু,
পিতৃতুল্য, পিতৃব্যতুল্য, মাতুল, শ্বশ্রূ, পৌত্র, শ্যালক, এবং অন্যান্য আত্মীয়দের
হত্যা করতে চাইনা যারা আমাদেরকে হত্যা করতে উদ্যত। (1.34-35) হে প্রভু কৃষ্ণ, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের বধ করে আমরা কি
প্রশান্তি পাব? এই
দুর্বৃত্তদের হত্যা করার মাধ্যমে, আমরা শুধুই পাপের ভাগী হব। (1.36) তাই আমাদের
জ্ঞাতিভাই, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের হত্যা করা উচিৎ নয়। যে কৃষ্ণ, স্বজন বধ করে আমরা কিভাবে খুশী
হব? (1.37) যদিও
তারা লোভের বশবর্তী হয়ে, পরিবারকে ধ্বংস করার পাপ দেখতে পাচ্ছে না, অথবা বন্ধুদের
বিনষ্ট করার অন্যায় দেখতে পাচ্ছেনা, কিন্তু হে কৃষ্ণ, আমরা যারা স্পষ্ট নিজ আত্মীয়
বধের পাপ অনুভব করতে পারছি, তাড়া কেন এই পাপকার্য থেকে বিরত থাকবো না? (1.38-39) অর্জুন যুদ্ধের ভয়াবহতা বর্ণনা করলেন পরিবার
ধ্বংস হলে চিরাচরিত পারিবারিক আচার আচরণ এবং ধর্ম বিনষ্ট হয়। পরিবারের সংস্কার
বিনষ্ট হলে পরিবারে অনৈতিকতা বিরাজ করে। (1.40) এবং যখন অনৈতিকতা বিরাজ করে, হে কৃষ্ণ,
পরিবারের কুলবধূরা ব্যভিচারে প্রবৃত্ত হয়, এবং যখন কুলবধূরা ব্যভিচারে প্রবৃত্ত
হয়, তখন বহু সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। (1.41) এটি সেই পরিবার এবং সেই পরিবারের
হত্যাকারীদের নরকে পতিত করে কারণ তাদের পূর্বপুরুষরা পিন্ড এবং তর্পণ জল না পাওয়ার
কারণে নরকে পতিত হন। (1.42)
যারা তাদের পরিবারকে ধ্বংস করে তাদের সামাজিক প্রথা এবং পারিবারিক সংস্কার
অবৈধতার পাপে নষ্ট নয়। (1.43)
হে কৃষ্ণ, আমি শুনেছি, যেসমস্ত মানুষের পারিবারিক সংস্কার বিনষ্ট হয়েছে
তাদেরকে দীর্ঘ নরকবাস করতে হয়। (1.44) যখন কঠিন সময় উপস্থিত হয়, কঠোর
মানুষও বিভ্রান্ত হতে পারে হায়! আমরা রাজ্যসুখের
লোভে আজকে নিজের আত্মীয়স্বজনকে হত্যা করার মহান অপরাধ করতে উদ্যত হয়েছি। (1.45) তার থেকে যদি আমি
যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্রপরিত্যাগ করি এবং যুদ্ধ না করি তাহলে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রের
তাদের নিজ অস্ত্রে আমাকে বধ করলেও বোধ করি এর থেকে অনেক ভালো হবে। (1.46) সঞ্জয় বললেন: যুদ্ধক্ষেত্রে
এটি বলে এবং তার শরধনু ফেলে দিয়ে, অর্জুন রথের উপর বসে পড়লেন মনে একরাশ দুঃখ নিয়ে।
(1.47) 2. তুরীয় জ্ঞান সঞ্জয়
বললেন: অশ্রুপূর্ণ
অবনত চোখে বসে থাকা, সমবেদনা এবং হতাশায় আচ্ছন্ন অর্জুনকে ভগবান কৃষ্ণ এই কথাগুলি
বললেন। (2.01) সর্বশক্তিমান
ঈশ্বর বললেন: এই
সন্ধিক্ষণে এই বিমর্ষতা কিভাবে তোমাকে গ্রাস করল? এটি মহৎ হৃদয় এবং কৃতির কোন ব্যক্তিকে শোভা পায় না। হে অর্জুন,
এটি লজ্জাজনক, এবং এই চিন্তা তোমাকে স্বর্গে নিয়ে যাবেনা। (2.02) হে অর্জুন,
কাপুরুষ হয়ো না, এ তোমাকে মানায় না। মনের দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে যুদ্ধের জন্য
প্রস্তুত হও, অর্জুন। (2.03)
অর্জুন যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বললেন অর্জুন
বললেন: হে
কৃষ্ণ, যে ভীষ্ম এবং দ্রোণ আমার পূজনীয় তাদের উপর যুদ্ধক্ষেত্রে আমি কিভাবে শর
প্রয়োগ করবো? (2.04) আমার মহান গুরুদের হত্যা করার চাইতে বরং পৃথিবীর মানুষের
দানের অন্নে বেঁচে থাকাও ভালো কারণ তাদের হত্যা করে আমি সেই ধনরাশি এবং সুখ ভোগ
করবো যা তাদের রক্তে রঞ্জিত। (2.05) আমরা জানিনা কোন বিকল্প --- যুদ্ধ করা অথবা না করা --- আমাদের জন্য ভালো
হবে, আমরা
জানিনা আমরা জয়লাভ করবো, নাকি ওরা জয়লাভ করবে। আমাদের সম্মুখে
দাঁড়িয়ে থাকা ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের হত্যা করার পর আমাদের এমনকি বেঁচে থাকা ইচ্ছা
প্রকাশ করাও উচিৎ নয়। (2.06) দয়ার দৌর্বল্যে আমার হৃদয় জর্জরিত, এবং কর্তব্য (ধর্ম) নিয়ে
আমার মুন বিভ্রান্ত। আমি অনুরোধ করছি, আমাদের নির্দেশ দিন, আমার জন্য কি শ্রেয়
হবে। আমি আপনার শিষ্য। আমি আপনার শরণ নিলাম, আমাকে শিক্ষা দিন। (2.07) আমার মনে হয় না পৃথিবীতে এক অদ্বিতীয় এবং সমৃদ্ধ রাজ্য প্রাপ্ত করা, এবং এমনকি
দেবতাদের উপর রাজত্ব পাওয়াও আমার এই দুঃখ মোচন করবে যা আমি এখন অনুভব করছি। (2.08) সঞ্জয় বললেন: হে রাজন, ভগবান
কৃষ্ণকে এই কথা বলার পরে বীর অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন: আমি যুদ্ধ করবো না, এবং মৌন হলেন। (2.09) হে রাজন, প্রভু
কৃষ্ণ, মধুর
হেসে দুই সৈন্যের মাঝে অবস্থিত বিষাদগ্রস্ত অর্জুনকে এই কথাগুলি বললেন (2.10) মহান প্রভু বললেন: তুমি তাদের জন্য বিষাদগ্রস্ত হও যারা যাদের জন্য শোক
করা উচিৎ নয়;
অথচ তুমি জ্ঞানীর মতো কথা বলছ। যারা
প্রকৃতই পণ্ডিত তাড়া জীবিত অথবা মৃত কারও জন্য শোক করেনা। (2.11)
এমন কোন সময় ছিলোনা যখন তুমি আমি অথবা এই রাজারা ছিলেন না, ভবিষ্যতেও এমন কোন
সময় থাকবে না যখন আমরা উপস্থিত থাকবো না। (2.12) ঠিক
যেমন জীব (আত্মা, জীব,
অথবা জীবাত্মা) তার
জীবনকালে শৈশব, যৌবন, এবং বার্ধক্যের শরীরের মধ্যে দিয়ে যায়; একইভাবে মৃত্যুর পড়ে
এটি নতুন শরীর ধারণ করে। জ্ঞানীরা কখনও এই বিষয়ে মুহ্যমান হন না।
(এছাড়াও দেখুন 15.08)
(2.13) ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সংস্পর্শে শীত, গ্রীষ্ম, সুখ,
দুঃখের অনুভব হয়। এগুলি অনিত্য এবং ক্ষণস্থায়ী। তাই, হে অর্জুন, এগুলিকে সহ্য করতে
শেখো। (2.14) কারণ
একজন শান্ত ব্যক্তি --- যিনি
বিষয়ের দ্বারা পীড়িত হন না, সুখ এবং দুঃখে অবিচলিত থাকেন --- তিনিই অমরত্বের
অধিকারী, হে
অর্জুন। (2.15) আত্মা চিরন্তন, দেহ ক্ষণস্থায়ী অদৃশ্য
আত্মা (সৎ, আত্মা) চিরন্তন, এবং
দৃশ্যমান জগত (নশ্বর
শরীর সহ) ক্ষণস্থায়ী।
যারা সত্য উপলব্ধি করেছেন তারা অবশ্যই এই দুই জগতের যথার্থতা দেখেছেন। (2.16) যে আত্মার দ্বারা
এই ব্রহ্মাণ্ড ব্যাপ্ত, তা অবিনশ্বর। অবিনশ্বর আত্মাকে
কেউই বিনষ্ট করতে পারেনা। (2.17)
এই চিরন্তন, অপরিবর্তনীয়, এবং ধারণাতীত আত্মার শরীর নশ্বর। তাই, যুদ্ধ করো, হে
অর্জুন। (2.18) যিনি মনে করেন আত্মা জীবহন্তা, এবং যিনি মনে করেন
আত্মাকে হত্যা করা হয়েছে, তারা উভয়েই অজ্ঞ। কারণ আত্মা হত্যা করে না এবং তাকে
হত্যা করা হয় না। (2.19) আত্মা জন্মায় না
এবং কোন সময় মারা যায় না। এটির অস্তিত্ব শুরু হয় না অথবা শেষ হয় না। এটি অজাত,
চিরন্তন, চিরস্থায়ী, এবং আদি। যখন শরীর নষ্ট হয় তখন আত্মা বিনষ্ট হয় না। (2.20) হে অর্জুন, যে ব্যক্তি জানেন
আত্মা অবিনশ্বর, অনাদি, অনাগত এবং অপরিবর্তনীয়, তিনি কিভাবে কাউকে বধ করবেন অথবা
কারও দ্বারা নিহত হবেন? (2.21) ঠিক যেমন ব্যক্তি পুরানো বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন
বস্ত্র পরিধান করেন; একইভাবে, জীবিত ব্যক্তি পুরানো শরীর পরিত্যাগ করে নতুন শরীর
ধারণ করেন। (2.22) অস্ত্রে আত্মাকে কাটা যায় না, আগুনে একে পোড়ানো
যায় না, জল এটিকে সিক্ত করে না, এবং বায়ু এটিকে শুষ্ক করেনা। এই আত্মা অচ্ছেদ্য,
অদাহ্য, অক্লেদ্য, এবং অশোষ্য। এই আত্মা চিরস্থায়ী, সর্বব্যাপী, অপরিবর্তনীয়, অচল
এবং সনাতন। (2.23-24) এই আত্মা
অবক্ত্য, অচিন্ত্য, এবং অবিকারি। আত্মা যেমন তেমন জেনে, আপনার দুঃখ পাওয়া উচিৎ নয়। (2.25) এমনকি যদি তুমি মনে করো আত্মা ক্রমাগত
জন্ম নিচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে, সেক্ষেত্রেও, হে অর্জুন, তোমার দুঃখ করার কোন কারণ
নেই। কারণ, যার জন্ম হয়েছে তার মৃত্যু অবধারিত। অতএব, অবশ্যম্ভাবী কাজ নিয়ে শোক
করা উচিৎ নয়। (2.26-27) হে অর্জুন, সমস্ত প্রাণী, অপ্রকাশিত – জৈব চক্ষুতে অদৃষ্ট
থাকে --- জন্মের
পূর্বে এবং মৃত্যুর পড়ে। তারা শুধুমাত্র জন্ম এবং মৃত্যুর মধ্যবর্তী সময়েই দৃষ্ট
হয়। এই নিয়ে দুঃখ করার কি আছে? (2.28) কেউ আত্মাকে
আশ্চর্যভাবে দর্শন করেন, কেউ আত্মার আশ্চর্য বর্ণনা দেন, এবং অন্যরা এটিকে
আশ্চর্যভাবে শ্রবণ করেন। এটি ব্যাপারে জানার পরেও, খুবই কম মানুষ এটিকে বুঝতে
পারেন। (2.29) হে
অর্জুন, দেহের
মধ্যে অবস্থিত আত্মা সর্বদাই অবধ্য। তাই, দেহ নিয়ে শোক করা তোমার উচিৎ নয়। (2.30) ভগবান কৃষ্ণ অর্জুনকে যোদ্ধা হিসাবে তার দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিলেন যোদ্ধা
হিসাবে তোমার নিজের কর্তব্য বিবেচনা করে, তোমার দ্বিধাগ্রস্ত হওয়া উচিৎ নয়। কারণ একজন যোদ্ধার কাছে ধর্মযুদ্ধের থেকে পুন্যশালী
কিছু নেই। (2.31) হে
অর্জুন, শুধুমাত্র সৌভাগ্যশালী যোদ্ধারা একটি অপ্রত্যাশিত যুদ্ধের সুযোগ পায়
স্বর্গের উন্মুক্ত দ্বারের মতো। (2.32) কিন্তু তুমি যদি এই ধর্মযুদ্ধ না করো, তাহলে তুমি তোমার
কর্তব্য থেকে ভ্রষ্ট হবে, তোমার যশ নষ্ট হবে, এবং তুমি পাপের ভাগী হবে। (2.33) মানুষ চিরকাল
তোমার কীর্তিহীনতার কথা বলবে। মানীর পক্ষে, মান হারানো অপেক্ষা
মৃত্যু শ্রেয়। (2.34) সমস্ত
মহারথীরা মনে করবেন তুমি ভয়ে এই যুদ্ধে পিছিয়ে গেছ। যারা তোমায় এতো সম্মান করতো
তারা তোমার জন্য সম্মান হারিয়ে ফেলবে। (2.35) তোমার শত্রুরা অনেক অকথা কুকথা বলবে এবং
তোমার সামর্থ্যের নিন্দা করবে। তোমার জন্য এর থেকে অধিকতর যন্ত্রণাদায়ক আর কি হতে
পারে? (2.36) (কর্তব্যের
খাতিরে) মৃত্যু হলে তুমি স্বর্গে যাবে, বিজয়ী হলে পৃথিবীতে রাজ্যপাট পাবে। অতএব,
হে অর্জুন, যুদ্ধের জন্য সংকল্প নিয়ে উঠে দাঁড়াও। (2.37) সুখ
দুঃখ, লাভ ক্ষতি, এবং জয় পরাজয়কে সমান জ্ঞান করে কর্তব্যের পথে এগিয়ে চলো। এই ভাবে
নিজের কর্তব্য পালন করলে, তুমি পাপের ভাগী হবে না। (2.38) কর্মযোগের গুরুত্ব, নিঃস্বার্থ সেবা হে
অর্জুন, তোমায় তুরীয় জ্ঞান প্রদান করেছি। এখন তুমি কর্মযোগের জ্ঞানের কথা শ্রবণ
করো, নিঃস্বার্থ সেবা, যার
মাধ্যমে তুমি নিজেকে কর্ম বন্ধন থেকে মুক্ত করতে পারবে। (2.39) কর্মযোগে, কোন প্রচেষ্টা ব্যর্থ
হয় না এবং বিপরীত প্রভাব নেই। এই শিক্ষার স্বল্প অভ্যাসও মানুষকে জন্ম এবং মৃত্যুর
ভয় থেকে রক্ষা করে। (2.40)
হে অর্জুন, একজন কর্মযোগীর A KarmaYogi ভগবানকে উপলব্ধি করার দৃঢ় সংকল্প আছে, কিন্তু যারা
কর্মফল উপভোগের জন্য কাজ করে তাদের আকাঙ্ক্ষা অশেষ এবং বহুমুখী। (2.41) বেদ জীবনের পার্থিব এবং আধ্যাত্মিক উভয় দিক নিয়ে কথা বলে বিপথগামী
মানুষেরাই বেদের সুমধুর জপ থেকে আনন্দ পায় --- বেদের আসল উদ্দেশ্য না বুঝে --- ভাবো, হে অর্জুন,
যেন বেদে শুধুমাত্র স্বর্গসুখ ভোগ করার উদ্দেশ্যে করা
ধর্মানুষ্ঠান ছাড়া কিছু নেই। (2.42) তারা পার্থিব ভোগের প্রতি আকৃষ্ট এবং মনে করে স্বর্গসুখ
লাভের থেকে জীবনের বড় উদ্দেশ্য কিছু নেই। সমৃদ্ধি এবং উপভোগের জন্য তারা নির্দিষ্ট কিছু আচার অনুষ্ঠানে মগ্ন হয়ে থাকে। পুনর্জন্ম
তাদের এই কর্মের ফলাফল। (2.43)
স্ব-উপলব্ধির দৃঢ় সংকল্প তাদের মনের মধ্যে সৃষ্টি হয়
না যারা আনন্দ এবং ক্ষমতার প্রতি আকৃষ্ট এবং তাদের বিচারবুদ্ধি এই ধরণের
আনুষ্ঠানিক কার্যক্রমে আচ্ছন্ন। (2.44) বেদের একটি অংশে জড় প্রকৃতির তিনটি অবস্থা (গুন) সম্বন্ধে
আলোচনা করা হয়েছে। সমস্ত দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত হও; অধিগ্রহণ এবং সংরক্ষণের উদ্বেগ বর্জন করে
সদা ভারসাম্য রাখো। হে অর্জুন, তুমি এই তিন গুনের ঊর্ধ্বে উঠে আত্ম চেতনায়
অধিষ্ঠিত হও। (2.45) একজন
আত্ম সচেতন মানুষের কাছে বেদ ততখানি কার্যকরী, যতখানি একটি ক্ষুদ্র জলাশয় এক বৃহৎ হ্রদের উপস্থিতিতে কার্যকরী। (2.46) কর্মযোগের তত্ত্ব এবং অনুশীলন তোমার শুধুমাত্র নিজ কর্মের উপর নিয়ন্ত্রণ আছে, তার
প্রাপ্ত ফলের উপর তোমার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। কর্মফলের আসক্তি নিয়ে কর্ম করা তোমার
উচিৎ নয়। কর্ম থেকে বিরত হওয়াও উচিৎ নয়। (2.47) হে অর্জুন, ভগবানের কথা মনে রেখে তোমার সর্বশ্রেষ্ঠ
সাধ্যমতো তোমার কর্তব্য পালন করো, ফলাফলের প্রতি চিন্তা এবং স্বার্থ ত্যাগ করো,
সাফল্য এবং ব্যর্থতা উভয় ক্ষেত্রেই শান্ত থাকো। মনের এই প্রশান্তিকেই কর্মযোগ বলা
হয়। (2.48) স্বার্থের কারণে কৃত কর্ম সর্বদা সেবা অথবা
কর্মযোগকৃত কর্মের তুলনায় হীন হয়। অতএব, হে অর্জুন, কর্মযোগী হও। যারা শুধুমাত্র নিজ শ্রমের ফল ভোগ করে, তারা সত্যিই, অসুখী।
(কারণ ফলাফলের উপর
কারও নিয়ন্ত্রণ নেই).
(2.49) A একজন
কর্মযোগী নিজের জীবনে উভয় পাপ এবং পুন্য থেকে মুক্ত। অতএব, কর্মযোগের জন্য সংগ্রাম
করুন। ফলের প্রতি আসক্ত না হয়ে নিজের সর্বশ্রেষ্ঠ সাধ্য মতো কাজ করে যাওয়াকেই
কর্মযোগ বলা হয়। (2.50) জ্ঞানী
কর্মযোগীরা কর্মজাত ফলের প্রতি স্বার্থ এবং আসক্তি ত্যাগ করে পুনর্জন্মের বন্ধন
থেকে মুক্ত হয় এবং পরম ঐশ্বরিক সুখ প্রাপ্ত করেন। (2.51) যখন তোমার বুদ্ধি সম্পূর্ণভাবে মোহের
অন্ধকার ভেদ করবে, তখন তুমি শাস্ত্রে কি লেখা আছে এবং তুমি কি শিখেছ তার প্রতি
উদাসীন হয়ে যাবে। (2.52) যখন বেদের বিরোধী মতামত এবং ধর্মীয়
মতবাদ দ্বারা বিভ্রান্ত তোমার বুদ্ধি অবিচলিত থাকবে এবং পরমেশ্বরের প্রতি একনিষ্ঠ
থাকবে, তখন তুমি সমাধি দ্বারা পরমেশ্বরের সঙ্গে একাত্মতা প্রাপ্ত
করবে। (2.53) অর্জুন
বললেন: হে কৃষ্ণ, অচলাবুদ্ধিসম্পন্ন স্থিতধী মানুষের লক্ষণ কি? স্থিতধী মানুষ কিভাবে কথা বলেন? কিভাবেই
অবস্থান করেন এবং কিভাবে বিচরণ করেন? (2.54) আত্ম-উপলব্ধি সম্পন্ন মানুষের
লক্ষণ পরমেশ্বর
বললেন: হে অর্জুন, যখন কেউ মনের সমস্ত আকাঙ্ক্ষা থেকে সম্পূর্ণরূপে
মুক্ত হয়ে যায়, এবং চিরন্তন সত্তা (ব্রহ্মা) তে সম্পূর্ণ প্রশান্তি লাভ করে,
চিরন্তন সত্তার আনন্দে আনন্দিত হয়, তখন তাকে স্থিতপ্রজ্ঞ বলা হয়। (2.55) A যে
ব্যক্তি দুঃখে বিচলিত হন না, যার সুখের প্রতি কোন স্পৃহা নেই, এবং যিনি
সম্পূর্ণভাবে আসক্তি, ভীতি এবং ক্রোধ থেকে মুক্ত, তাকেই স্থিতধী মুনি বলা হয়। (2.56)
যারা কিছুর প্রতি আসক্ত নন, তারা প্রিয় কিছু পেয়ে খুশী হন না, অপ্রিয় কিছু
পেলে দুঃখিত হন না, তাদের প্রজ্ঞা স্থিত বিবেচনা করা হয়। (2.57) কচ্ছপ যেমন তার
হাত-পা খোলসের ভিতর আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে লুকিয়ে ফেলে, কোন ব্যক্তি যখন
ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর থেকে তার ইন্দ্রিয়কে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করে নিতে
পারেন, তেমন ব্যক্তির বুদ্ধিকে স্থিতধী বলা হয়। (2.58) ব্যক্তি ইন্দ্রিয়সুখ থেকে দূরে থাকতে
পারে, কিন্তু তার ইন্দ্রিয়সুখের আসক্তি থেকে যায়। কিন্তু যিনি পরমেশ্বরকে জেনেছেন
তার থেকে এই আসক্তি নষ্ট হয়ে যায়। (2.59) হে অর্জুন, অস্থির ইন্দ্রিয়, এমনকি যত্নশীল জ্ঞানী
ব্যক্তিরও চিত্তবিক্ষেপ ঘটাতে পারে। (2.60) ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণে এনে প্রেমময় চিত্তে আমাতে
মনঃসংযোগ করা উচিৎ। ইন্দ্রিয়
সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসলেই মানুষ স্থিতপ্রজ্ঞ হতে পারে। (2.61)
ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের ব্যাপারে
চিন্তা দ্বারা মানুষ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের প্রতি আসক্তি সৃষ্টি করে।
ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের প্রতি আসক্তি থেকে বিষয়ের প্রতি কামনার জন্ম, এবং
অপরিপূর্ণ কামনা থেকে ক্রোধের জন্ম হয়। (2.62) ক্রোধ
থেকে বিভ্রান্তি এবং ভ্রান্ত ধারনার সৃষ্টি হয়। বিভ্রান্তি থেকে মন বিক্ষিপ্ত হয়।
মন বিক্ষিপ্ত হলে যুক্তিযুক্ততা নষ্ট হয়। যুক্তিযুক্ততা
নষ্ট হলে মানুষ পথভ্রষ্ট হয়। (2.63) ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ এবং আত্মজ্ঞানের মাধ্যমে শান্তি এবং আনন্দ প্রাপ্তি একজন
সংযতচিত্ত মানুষ, যিনি নিয়ন্ত্রণে থাকা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য
বস্তুকে উপভোগ করেন, তিনি প্রশান্তি অর্জন করেন। (2.64) প্রশান্তি
প্রাপ্তির মাধ্যমে সকল দুঃখ দূর হয়। প্রশান্ত ব্যক্তির বুদ্ধি দ্রুত স্থিতি
লাভ করে এবং চিরন্তন সত্তার সঙ্গে একত্রিত হয়। (2.65) চিরন্তন সত্তার সঙ্গে যারা মিলিত নন তাদের
মধ্যে আত্ম-জ্ঞান এবং আত্ম-ধারনা কোনটিই থাকতে পারেনা। আত্ম-ধারনা ছাড়া কোন শান্তি
নেই, শান্তি ছাড়া কোন আনন্দ নেই। (2.66) ঝড় যেমন নৌকাকে তার
লক্ষ্য থেকে দূরে নিয়ে যায়, বিচলিত ইন্দ্রিয় মনকে স্থিরবুদ্ধি থেকে দূরে নিয়ে যায় –
আধ্যাত্মিক তটভূমি থেকে। (2.67) অতএব, হে অর্জুন,
যার ইন্দ্রিয়গুলি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু থেকে সম্পূর্ণ নিবৃত্ত হয়েছে তিনিই
স্থিতপ্রজ্ঞ। (2.68) একজন
যোগী, সংযমী ব্যক্তি, তখন জেগে থাকেন যখন সবার জন্য রাত্রি। যখন সবাই জেগে তখন
যোগীর জন্য রাত্রি। (2.69)
(যখন বেশীরভাগ মানুষ রাত্রে ঘুমান এবং অবাস্তব জগতের স্বপ্ন
দেখেন, একজন
যোগী জগতের মধ্যে বাস করেও তার থেকে উদাসীন থাকেন অথবা জেগে থাকেন।) যখন সমস্ত
আকাঙ্ক্ষা বিনষ্ট হয় এবং মনকে বিচলিত করে না তখন মানুষ শান্তি লাভ করে,
ঠিক যেমন নদীর জল সমুদ্রে প্রবেশ করে
সমুদ্রকে বিচলিত করতে পারে না। বিষয়কামী মানুষ কখনও শান্তি লাভ করে না। (2.70)
যে ব্যক্তি সকল কামনা ত্যাগ করেন, তিনি “আমি” এবং
“আমার” ও সকল বন্ধন মুক্ত হন, শান্তি পান। (2.71) হে অর্জুন, এটি মনের অতিসচেতন অবস্থা
(ব্রাহ্মী)। এই অবস্থা প্রাপ্ত করলে, মানুষ মোহের বশীভূত থাকেনা। এই অবস্থা
প্রাপ্ত করলে, এমনকি জীবনের শেষ পর্যায়েও, একজন ব্যক্তি ব্রহ্মনির্বাণ প্রাপ্ত করেন। (অথবা পরমের সঙ্গে
একাত্ম হয়ে যান). (2.72) 3. কর্মযোগের পথ অর্জুন
বললেন: হে
কৃষ্ণ, যদি আপনি মনে করেন তুরীয় জ্ঞান প্রাপ্তি কর্মের অপেক্ষা মহৎ, তাহলে কেন আপনি আমাকে এই ভয়ানক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে
বলছেন? আপনি পরস্পরবিরোধী কথা বলে আমার মনকে বিভ্রান্ত করে দিচ্ছেন। নিশ্চিত করে
আমাকে একটি জিনিসের কথা বলুন, যাতে আমি পরমাত্মায় স্থান পাই। (3.01-02) পরমেশ্বর বললেন: এই পৃথিবীতে, হে অর্জুন, আমি আগেই বলেছি আধ্যাত্মিক
অনুশীলনের দুটি পথ আছে --- আত্ম-জ্ঞানের পথ (জ্ঞান যোগ) চিন্তাশীল মানুষের জন্য, এবং সক্রিয় মানুষের জন্য নিষ্কাম কর্মের পথ (সেবা, কর্মযোগ)। (3.03) কর্ম থেকে বিরত
থেকে কর্মবন্ধন মুক্ত হওয়া যায় না। আবার কর্মত্যাগের মাধ্যমেও সিদ্ধি লাভ করা যায়
না। (3.04) অসহায়
ভাবে --- প্রকৃতির গুনে --- কেউই নিষ্কর্মা হয়ে
মুহূর্তের জন্যেও থাকতে পারেন না, সবাইকেই বাধ্য হয়ে কর্ম করতে হয়। (3.05) যে মুঢ় ব্যক্তি, নিজের
শরীরকে সংযত করার পরেও মানসিকভাবে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ভোগের পথে থাকে, তাদেরকে মিথ্যাচারী ভণ্ড বলে। (3.06) যিনি ইন্দ্রিয়গুলিকে প্রশিক্ষিত এবং বিশুদ্ধ মনে
নিয়ন্ত্রণ করেন এবং নিষ্কাম কর্ম সম্পাদন করেন, তিনি অনেক শ্রেয়, হে অর্জুন। (3.07)
তুমি তোমার অবশ্য কর্তব্য পালন করো কারণ নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকার থেকে কর্ম
শ্রেয়। কর্ম ব্যতীত আপনার শরীরের রক্ষণাবেক্ষণও অসম্ভব হয়ে পড়বে। (3.08) মনুষ্য জীবন সেই কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ যা নিষ্কাম নয়। অতএব,
হে অর্জুন, কর্মফলের প্রতি স্বার্থপর আসক্তি থেকে মুক্ত হয়ে, আমার সেবা হিসাবে
আপনার কর্তব্য দক্ষতার সঙ্গে পালন করুন। (3.09) স্রষ্টার প্রথম আদেশ একে অপরকে সাহায্য করা সৃষ্টির
প্রারম্ভে ভগবান ব্রহ্মা, সৃষ্টিকর্তা, নিষ্কাম কর্ম (সেবা, যজ্ঞ, বলিদান) সহযোগে
মনুষ্য সৃষ্টি করে এবং বলেন: যজ্ঞের দ্বারা তুমি সফল হবে, যজ্ঞের দ্বারা তোমার মনস্কামনা
পূর্ণ হবে। (3.10) নিষ্কাম
সেবা দ্বারা দেবতাদের পুষ্ট করুন, এবং তারা আপনাকে পুষ্ট করবে। এইভাবে একে অপরকে
পুষ্ট করে আপনারা সর্বোচ্চ লক্ষ্য অর্জন করেন। (3.11) নিষ্কাম সেবার দ্বারা তুষ্ট হয়ে দেবতারা
আপনার মনোমত বস্তু আপনাকে প্রদান করবেন। যিনি দেবতাদের দেওয়া উপহারকে দেবতাদের
নিবেদন না করে ভোগ করেন, তিনি অবশ্যই চোর। (3.12) ধার্মিক ব্যক্তি যিনি নিষ্কাম কর্মের অবশিষ্টাংশ
ভক্ষণ করেন তিনি সকল পাপ থেকে মুক্ত, কিন্তু যে অধার্মিক ব্যক্তি শুধুমাত্র নিজের
জন্য খাদ্য প্রস্তুত করেন (আমাকে নিবেদন না করে, অথবা অন্যান্যদের সঙ্গে ভাগ না
করে নিয়ে), তিনি
প্রকৃত অর্থেই পাপী। (3.13)
অন্ন দ্বারা জীবিত প্রাণী জীবনধারণ করে; বৃষ্টি হওয়ার ফলে অন্ন উৎপন্ন হয়; নিষ্কাম কর্ম করলে তবেই বৃষ্টি আসে (দেবতাদের
অনুগ্রহে) (এছাড়াও
দেখুন 4.32)।কর্তব্যকর্ম
বেদে বলা আছে। বেদ এসেছে ব্রহ্মা (চিরন্তন সত্তা) থেকে। সুতরাং সেবার মধ্যে
সর্বব্যাপী ব্রহ্ম সতত উপস্থিত। (3.14-15) যে অর্জুন, যে
ব্যক্তি নিষ্কাম কর্ম (সেবা) এর মাধ্যমে সৃষ্টির চাকা সচল রাখতে সাহায্য করেন না,
এবং যিনি ইন্দ্রিয়সুখ ভোগে ব্যস্ত
থাকেন, সেই মহাপাপী বৃথা জীবন ব্যয় করে। (3.16) আত্ম-সচেতন
মানুষ, যিনি শুধুমাত্র চিরন্তন সত্তার জন্য আনন্দিত হন, প্রীত হন, এবং সন্তুষ্ট
হন, তার কোন কর্তব্য নেই। (3.17)
তেমন ব্যক্তির কোন আগ্রহ নেই জগতে কি ঘটলো বা কি ঘটলো না তাই নিয়ে। একজন
আত্ম-সচেতন ব্যক্তি (ভগবান ছাড়া) আর কোন প্রাণীর উপর কিছুর জন্য ভরসা করেন না। (3.18) নেতাদের উদাহরণ স্থাপন করা উচিৎ অতএব, সবসময় কর্মফলের প্রতি আসক্তি মুক্ত হয়ে
দক্ষতার সঙ্গে আপনার কর্তব্য পালন করুন, কারণ, আসক্তিবিহীন কাজের মাধ্যমেই পরমেশ্বরকে পাওয়া যায়। (3.19)
রাজা জনক এবং অন্যান্যরা শুধুমাত্র
নিষ্কাম কর্ম (কর্মযোগ) দ্বারাই সিদ্ধি প্রাপ্ত (অথবা আত্ম-সচেতন) হয়েছিলেন।
তোমারও উচিৎ সমাজের সর্বহিতের
জন্য, মানুষকে নির্দেশ দেওয়ার জন্য তোমার কর্তব্য পালন করা (3.20)
মহান ব্যক্তিরা যা করেন, অন্যেরা তা অনুসরণ করে। তারা যে মানদণ্ড নির্দিষ্ট
করে যান, পৃথিবী সেই মতো চলে। (3.21) হে অর্জুন, এই ত্রিভুবনে (স্বর্গ, মর্ত্য, এবং পাতাল) আমার
কর্তব্য কিছুই নেই, আমার অপ্রাপ্ত কিছুও নেই, তবুও আমি কর্মে ব্যাপৃত আছি। (3.22) হে অর্জুন, যদি
আমি সদা কর্মে ব্যাপৃত না হই, তাহলে জগতের সমস্ত মানুষ আমাকে অনুসরণ করে কর্ম
পরিত্যাগ করবে। আমি কাজ না করলে পৃথিবী বিনষ্ট
হবে, এবং আমি এই সমস্ত মানুষের বিভ্রান্তি এবং ধ্বংসের কারণ হবো। (3.23-24) যে অর্জুন, অজ্ঞ
ব্যক্তি যেমন কর্মফলের আশায় কাজ করে, জ্ঞানীর উচিৎ তেমন অনাসক্ত কর্ম করা জগতের কল্যাণের জন্য। (3.25) জ্ঞানী ব্যক্তিরা কর্মফলাসক্ত অজ্ঞানী ব্যক্তিদের মন
বিভ্রান্ত করবেন না, বরং অনাসক্ত কর্ম সম্পূর্ণ দক্ষতার সঙ্গে করে অন্যদের তাদেরকে
অনুপ্রাণিত করবেন। (এছাড়াও দেখুন 3.29) (3.26) সমস্ত কাজ প্রকৃতির শক্তি এবং খমতায় হয়, কিন্তু
অজ্ঞানতার মোহে, মানুষ ভেবে নেয় তারা নিজেরা এই কাজ সম্পাদন করেছে। (এছাড়াও দেখুন 5.09, 13.29, এবং 14.19) (3.27) হে
অর্জুন, যে জ্ঞানী ব্যক্তি কর্ম এবং প্রকৃতির শক্তিগুলির সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত,
তারা কর্মে আসক্ত হন না, কারণ তারা জানেন প্রকৃতির শক্তি তাদের মাধ্যমে এই কার্য
করিয়ে নিচ্ছে। (3.28) প্রকৃতির মায়ায় মোহাচ্ছন্ন হয়ে মুঢ়মতি মানুষ প্রকৃতির বলে
হওয়া কাজের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। জ্ঞানী কখনও এই ধরণের অজ্ঞানী মানুষের মন
বিচলিত করেন না। (এছাড়াও
দেখুন 3.26) (3.29) নিজের কর্তব্য করো --- সমস্ত কাজ আমাকে সমর্পণ করে ---
আধ্যাত্মিক মন নিয়ে, কামনামুক্ত, অনাসক্ত ও বীতশোক হয়ে। (3.30)
তারা যারা আমার এই শিক্ষা সর্বদা মেনে চলে --- বিশ্বাসের সঙ্গে (সম্পূর্ণ মন এবং
আন্তরিকতা দিয়ে) এবং
ঈর্ষা থেকে যারা মুক্ত ---
তারা কর্মের বন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করে। কিন্তু যারা আমার এই উপদেশ পালন করেন
না তাদেরকে সর্বজ্ঞানহীন, মুঢ়, এবং ভ্রান্ত বলে জানবে। (3.31-32) সমস্ত প্রাণী
নিজেদের প্রকৃতি অনুসরণ করে। জ্ঞানী ব্যক্তি নিজ প্রকৃতি অনুযায়ী আচরণ করেন। তাহলে
দমন করার কি গুরুত্ব?
(3.33) ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর প্রতি আসক্তি অথবা বিরক্তি
ইন্দ্রিয়ের মধ্যে থাকে। এই দুটি আত্ম-উপলব্ধিঢ় পথে সবচেয়ে বড় বাধা, তাই এর দ্বারা
নিজেকে বশীভূত হতে দেওয়া উচিৎ নয়। (3.34) নিজের স্বাভাবিক
কাজ অন্যের কাজের তুলনায় নিকৃষ্ট মনে হলে তা করা শ্রেয়। নিজের কাজে মৃত্যু হলে তাও
ভালো। অন্যের স্বাভাবিক কাজ করা খুবই বিপদজনক। (এছাড়াও দেখুন 18.47) (3.35) পাপের উৎস অভিলাষ অর্জুন
বললেন: হে
কৃষ্ণ, মানুষ কেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেন কোন এক বলপূর্বক পাপাচরণে নিয়োজিত হয়? (3.36) পরমেশ্বর বললেন: কাম (অথবা পার্থিব বা ইন্দ্রিয়সুখের জন্য প্রবল বাসনা),
যা গভীর আসক্তি থেকে জন্মায়, যা পূর্ণ
না হলে ক্রোধে পরিণত হয়। কাম সর্বগ্রাসী এবং মহাপাপ। এটিকে শত্রুরূপে জানবে। (3.37)
আগুন যেমন ধোঁয়ায় আবৃত থাকে, দর্পণ
যেমন ধূলায় আবৃত থাকে, গর্ভস্থ শিশু যেমন জরায়ুতে আবৃত থাকে, একইভাবে, আত্ম-জ্ঞান
কামের দ্বারা আবৃত থাকে। (3.38) হে অর্জুন, আত্ম-জ্ঞান
কামের এই সর্বগ্রাসী আগুনে ঢাকা পড়ে যায়, যা জ্ঞানীর চিরকালের শত্রু। (3.39) ইন্দ্রিয়, মন এবং বুদ্ধি এই তিনটি কামের আশ্রয়স্থল। কাম ---
ইন্দ্রিয়, মন এবং বুদ্ধির দ্বারা
নিয়ন্ত্রিত হয়ে --- তার আত্ম-জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করে তাকে বিভ্রান্ত করে। (3.40)
অতএব, হে অর্জুন, প্রথমে ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে, পার্থিব সুখের এই
পাপকে বিনাশ করো যা আত্ম-জ্ঞান এবং আত্ম-উপলব্ধি নষ্ট করে। (3.41) ইন্দ্রিয়গুলিকে
শরীরের তুলনায় শ্রেয় বলা হয়; মন ইন্দ্রিয়ের তুলনায় শ্রেয়; বুদ্ধি মনের তুলনায় শ্রেয়; এবং আত্মা
বুদ্ধির তুলনায় শ্রেয়। (এছাড়াও
দেখুন 6.07-08) (3.42) অতএব, হে অর্জুন, বুদ্ধির তুলনায় আত্মাকে শ্রেয় জেনে,
বুদ্ধির (যা আধ্যাত্মিক অনুশিলনে শুদ্ধ) দ্বারা মনকে সংযত করে,
কামরূপী এই দুর্জয় শত্রুকে জয় করো। (3.43) 4. জ্ঞানের সাহায্যে আত্মত্যাগের পথ পরমেশ্বর
ভগবান বললেন: আমি রাজা
বিবস্বানকে সঠিক কর্মের এই চিরন্তন বিজ্ঞান কর্মযোগ শিখিয়েছিলাম। বিবস্বান তা
শেখালেন মনুকে। মনু শেখালেন ইক্ষ্বাকুকে। এইভাবে পরম্পরার মাধ্যমে বিদ্বান রাজনেরা
এটি (কর্মযোগ) জানতেন। কালের প্রভাবে কর্মযোগ এই পৃথিবী থেকে বিস্মৃত হয়েছিল। আজকে, আমি সেই প্রাচীন বিজ্ঞান তোমাকে আবার
বর্ণনা করছি কারণ তুমি আমার একনিষ্ঠ ভক্ত এবং বন্ধু। কর্মযোগ এক গূঢ়
রহস্য। (4.01-03) অর্জুন
বললেন: বিবস্বান
প্রাচীন কালে জন্মেছিলেন, আপনার জন্মের অনেক আগে। আপনি সৃষ্টির প্রারম্ভে যে তাকে
এই জ্ঞান শিখিয়েছিলেন তা আমি কি করে বুঝবো? (4.04) পরমেশ্বর
ভগবান বললেন: তুমি এবং
আমি উভয়েই বহু জন্ম নিয়েছি। আমি তাদের সবগুলিকেই মনে করতে পারি, হে অর্জুন, কিন্তু
তুমি পারো না। (4.05) যদিও আমি
অনাদি, অব্যয় এবং সকল জগতের প্রভু, তবু আমি আমার স্বর্গীয় শক্তি (যোগমায়া) কে
আশ্রয় করে আমার নিজ প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করে
নিজেকে প্রকাশ করি। (এছাড়াও
দেখুন 10.14) (4.06) হে অর্জুন, যখনই সংসারে ধর্মের (সদাচার) অবক্ষয় হয় এবং অধর্মের (দুরাচার) অভ্যুত্থান দেখা যায়, আমি
নিজেকে প্রকাশ করি। সাধু ব্যক্তির রক্ষা করার জন্য, অসাধু ব্যক্তিকে পরিবর্তন করার
জন্য, এবং পৃথিবীতে শান্তি বজায় (ধর্ম) রাখার জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই। (4.07-08)
যিনি প্রকৃতই আমার দিব্য এবং কর্ম (সৃষ্টি, স্থিতি, এবং লয়) বোঝেন, হে অর্জুন,
তাঁকে এই দেহ ত্যাগ করার পরে আর পুনর্জন্ম নিতে হয় না, তিনি আমার দিব্যধামে বাস
করেন। (4.09) আমাতে
আশ্রয় নিয়ে, আমার চিন্তায় মগ্ন হয়ে, আত্ম-জ্ঞানের অগ্নিতে পবিত্র হয়ে, বহু মানুষ
আসক্তি, ভয়, ক্রোধ থেকে মুক্ত হয়েছেন এবং নির্বাণ (মুক্তি) পেয়েছেন। (4.10) যে
অভিপ্রায়েই মানুষ আমার উপাসনা করে থাকুক, আমি তাদের মনোস্কামনা পূর্ণ করি। মানুষ
বিভিন্ন অভিপ্রায়ে আমার উপাসনা করেন। (4.11) বহু মানুষ পার্থিব কাজের সাফল্যের জন্য
দেবদেবীর আরাধনা করেন। পার্থিব জগতে সাফল্য দ্রুত আসে। (4.12) প্রবণতা এবং বৃত্তির উপর ভিত্তি করে মনুষ্য সমাজের চারটি
বিভাগ আমি সৃষ্টি করেছিলাম। যদিও আমি শ্রম বিভাজনের এই প্রথার স্রষ্টা, তোমার জানা
উচিৎ আমি কিছুই করিনা এবং আমি চিরন্তন।
(এছাড়াও দেখুন 18.41)
(4.13) কর্ম অথবা কর্মফল আমাকে আবদ্ধ করে না, কারণ কর্মের ফলের
প্রতি আমার কোন আসক্তি নেই। যিনি এই তত্ত্ব সম্পূর্ণ বোঝেন এবং অনুশীলন করেন তিনি
কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ নন। (4.14)
প্রাচীনকালের সমস্ত মুক্তিকামী মানুষ এই বোধ সহ নিজেদের কর্তব্য পালন করতেন।
অতএব, তোমার উচিৎ তাদের মতোই
তোমার কর্তব্য পালন করা। (4.15) সংযুক্ত, বিচ্ছিন্ন, এবং নিষিদ্ধ ক্রিয়া কোনটি
কর্ম এবং কোনটি অকর্ম তা নিয়ে এমনকি জ্ঞানীরাও বিভ্রান্ত। অতএব আমি তোমাকে
স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করবো কর্ম কি, এবং এটি জেনে তুমি জন্ম এবং মৃত্যুর এই অশুভ
অবস্থা থেকে মুক্তিলাভ করবে। (4.16) কর্মের প্রকৃত তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করা কঠিন। তাই তোমার উচিৎ সকাম কর্ম (স্বার্থযুক্ত) এর প্রকৃতি, নিষ্কাম কর্ম (স্বার্থহীন)
এর প্রকৃতি, এবং এছাড়াও নিষিদ্ধ কর্মের প্রকৃতি সম্বন্ধে জানা। (4.17) কর্মযোগী কর্মফলের নিয়মে আবদ্ধ নন যিনি কর্মে অকর্ম দর্শন করেন এবং অকর্মে কর্ম দর্শন
করেন তিনি জ্ঞানী। এমন মানুষ যোগী এবং তিনি সমস্তকিছু সিদ্ধ করেছেন। (এছাড়াও দেখুন 3.05, 3.27, 5.08 এবং 13.29) (4.18) (কর্ম অকর্ম এবং
তদ্বিপরীত বোধ করা অর্থাৎ এটি বোঝা
যে ভগবান তার ক্ষমতা ব্যবহার করে পরোক্ষভাবে আমার দ্বারা সমস্ত কার্য সম্পাদন
করান। তিনি নিষ্ক্রিয় কারক। আমরা সক্রিয়ভাবে নিষ্ক্রিয় কারণ তার শক্তির প্রবাহ
ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারি না। অতএব, আমরা কারক নই, আমরা শুধুমাত্র তাঁর হাতের
যন্ত্র) আত্ম-জ্ঞানের
আগুনে পুড়ে যে ব্যক্তির সমস্ত কামনা স্বার্থহীন, জ্ঞানী ব্যক্তি তাঁকে সাধু বলেন। (4.19) যিনি সমস্ত কর্মের ফলাফলের প্রতি স্বার্থপর আসক্তি ত্যাগ
করেছেন, সদা
সন্তুষ্ট থাকেন এবং ঈশ্বর ভিন্ন অন্য কারও উপর নির্ভরশীল হন না, তেমন ব্যক্তি ---
যদিও কর্মে রত থাকেন ---
তার শুভ বা অশুভ কোন কর্মফল প্রাপ্ত
হয় না। (4.20)
তিনি যিনি কামনা মুক্ত, যার মন এবং ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণে আছে, এবং যিনি সমস্ত
অধিকার পরিত্যাগ করেছেন, তিনি
পাপের ভাগী হন না --- কর্মফল
ভোগ করে না --- শারীরিক
কর্ম করলেও। (4.21) যে
কর্মযোগী তাঁর ইচ্ছেয় স্বাভাবিকভাবে যা হচ্ছে তাতে সন্তুষ্ট থাকেন, জিনিস
দ্বন্দ্বের বশীভূত হন না, যিনি মাৎসর্য মুক্ত,
সাফল্য এবং ব্যর্থতায় যিনি শান্ত, যদিও সর্বদা কর্মে ব্যাপৃত, তিনি কর্মফলের বন্ধনে
আবদ্ধ নন। (4.22) জিনিস
সমস্ত আসক্তি মুক্ত, যার মন আত্ম-জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত, যিনি সমস্ত কর্ম ভগবানের সেবা
হিসাবে করেন, তেমন পরোপকারী ব্যক্তির (কর্মযোগী) কর্মফল লোপ পায়। (4.23) ব্রহ্মা, চিরন্তন সত্তা, কে উপলব্ধি করা যায় যখন সমস্ত কর্মকে ব্রহ্মের
প্রকাশ হিসাবে বিবেচনা করা যায়। (এছাড়াও দেখুন 9.16) (4.24) বিভিন্ন ধরণের আধ্যাত্মিক অভ্যাস কিছু
যোগী দেবতাদের উপাসনা করেন,
অন্যান্য যোগীরা আত্ম-জ্ঞানের জন্য শাস্ত্রপাঠ করেন। কিছু মানুষ নিজেদের
ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ করেন এবং পার্থিব সুখ বিসর্জন দেন। অন্যান্যরা প্রানায়াম সমূহ
যোগাসন অভ্যাস করেন। কিছু মানুষ দান করেন এবং তাদের সম্পদ বলিদান দেন। (4.25-28) যারা যোগ অভ্যাস
করেন তারা প্রানবায়ুকে অপানবায়ুতে এবং অপানবায়ুকে প্রানবায়ুতে প্রদান করে অবশেষে
বায়ুর গতিরোধ করে সমাধিস্থ হন। (4.29) অন্যান্যরা খাদ্যাভ্যাসের সীমাবদ্ধতা এনে প্রানবায়ুকে
প্রানবায়ুতে উৎসর্গ করেন।
এই সমস্ত মানুষ উৎসর্গ বোঝেন,
এবং তাদের উৎসর্গের দ্বারা
পবিত্র হয়ে যান। (4.30) যারা নিষ্কাম কর্ম করেন তারা আত্ম-জ্ঞানের অমৃত লাভ
করেন উৎসর্গের ফলাফল হিসাবে এবং চিরন্তন
সত্তাকে পাওয়ার জন্য। হে অর্জুন, উৎসর্গ না করে এই জগতে কেউই সুখী থাকতে পারে না,
তাহলে অন্য জগতে কি হবে?
(এছাড়াও দেখুন 4.38,
এবং 5.06). (4.31) বেদে বহু
প্রকারের আধ্যাত্মিক অনুশীলনের বর্ণনা রয়েছে। তাদের সবাইকে কর্ম অথবা শরীর, মন এবং
ইন্দ্রিয় কর্মজাত হিসাবে জানবে। এটি জেনে, তুমি মুক্তি লাভ করবে (মোক্ষ, নির্বাণ). (এছাড়াও দেখুন 3.14) (4.32) অতীন্দ্রিয় জ্ঞান প্রাপ্ত করা শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক অভ্যাস যেকোনো পার্থিব লাভ অথবা পুরস্কারের চাইতে
আত্ম-জ্ঞান লাভ এবং তাঁর সম্প্রসারণ শ্রেয়, হে অর্জুন। কারণ সমস্ত কর্ম জ্ঞানেই
পরিসমাপ্তি লাভ করে। (4.33) বিনীত শ্রদ্ধা,
আন্তরিক প্রশ্ন, এবং সেবার দ্বারা এই অতীন্দ্রিয় জ্ঞান কোন আত্ম-জ্ঞান সম্পন্ন
মানুষের থেকে প্রাপ্ত করা যায়। সত্যদ্রষ্টা জ্ঞানী তোমাকে শেখাবে। (4.34) হে অর্জুন, সত্য
জানার পরে তুমি আর মোহান্ধ হবে না। এই জ্ঞান দ্বারা তুমি বুঝবে আমার মধ্যেই সমগ্র
সৃষ্টি, পরমেশ্বর ভগবান আমি, এবং তোমার উচ্চ আত্ম অবস্থার মধ্যেও আমি (এবং সবের
মধ্যেই আমাকে দেখবে) (4.35)
তুমি যদি সর্ব পাপীর মধ্যেও পাপিষ্ঠ বলে গণ্য হও, তাহলেও শুধুমাত্র
আত্ম-জ্ঞানের ভেলায় পাপের মহাসমুদ্র পার করে যেতে পারবে। (4.36) জ্বলন্ত অঙ্গি
যেমন কাঠকে ভস্মে পরিণত করে; একইভাবে, আত্ম-জ্ঞান কর্মফলের সমস্ত বন্ধনকে ভস্মে পরিণত করে, হে
অর্জুন। (4.37) অতীন্দ্রিয় জ্ঞান স্বয়ংক্রিয়ভাবে একজন কর্মযোগীর কাছে প্রকাশিত হয় বাস্তবিকই,
পরমাত্মার সত্য জ্ঞানের মতো পবিত্র পদার্থ এই জগতে
আর নেই। যিনি কর্মযোগের মাধ্যমে পবিত্র হন তিনি স্বাভাবিকভাবে সময়ের
সঙ্গে নিজের মধ্যে এই জ্ঞান পরিস্ফুট হতে দেখেন। (এছাড়াও দেখুন 4.31, এবং 5.06, 18.78) (4.38) যার
বিশ্বাস আছে, যিনি আন্তরিকভাবে যোগ অভ্যাস করেন, এবং যার নিজ ইন্দ্রিয়ের উপর
নিয়ন্ত্রণ আছেন, তিনি এই অতীন্দ্রিয় জ্ঞান লাভ করেন। এটি জ্ঞান প্রাপ্ত করে,
অচিরেই পরম শান্তি প্রাপ্ত হয় (4.39) অযৌক্তিক, অবিশ্বাসী, এবং শ্রদ্ধাহীন বিনষ্ট হয়। অবিশ্বাসীর
জন্য এই জগত এবং পরলোকেও কোন আনন্দ নেই। (4.40) নির্বাণের জন্য উভয় অতীন্দ্রিয় জ্ঞান এবং কর্মযোগ প্রয়োজন হে
অর্জুন, যিনি নিষ্কাম কর্ম দ্বারা কর্মত্যাগ করেছেন, এবং আত্ম-জ্ঞান দ্বারা সংশয়
ত্যাগ করেছেন, তাঁকে কর্মফলের বন্ধন আবদ্ধ করতে পারে না। (4.41) অতএব,
আত্ম-জ্ঞানের তরবারি দ্বারা অজ্ঞানতা প্রসূত সংশয়ের নাশ করো, কর্মযোগকে আশ্রয় করে,
যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও, হে অর্জুন। (4.42) 5. আত্মত্যাগের
পথ অর্জুন
বললেন: হে
কৃষ্ণ, আপনি অতীন্দ্রিয় জ্ঞানের প্রশংসা করেন আবার নিষ্কাম কর্মও করতে বলেন। আমাকে
নিশ্চিত করে বলুন, দুটির মধ্যে কোনটি বেশী ভালো। (এছাড়াও দেখুন 5.05) (5.01) পরমেশ্বর বললেন: আত্ম-জ্ঞানের পথ এবং সেবার পথ উভয় তোমাকে মূল লক্ষ্যে নিয়ে যাবে। কিন্তু,
দুইয়ের মধ্যে নিষ্কাম সেবার পথ আত্ম-জ্ঞানের থেকে শ্রেয়। (5.02) একজন ব্যক্তিকে
সত্যকার সন্ন্যাসী বিবেচনা করা হবে যখন তিনি পছন্দ বা অপছন্দ কোনটাই করবেন না। হে
অর্জুন, বিপরীত দ্বন্দ্বের থেকে মুক্ত হয়ে একজন সহজের কর্মফলের বন্ধন থেকে মুক্ত
হতে পারে। (5.03) শুধুমাত্র মূর্খরাই আত্ম-জ্ঞান (অথবা আত্মত্যাগ) এবং
নিষ্কাম কর্ম (কর্মযোগ) এর পথকে পৃথক জ্ঞান করেন, জ্ঞানীরা নয়। যে ব্যক্তি কোন
একটির যথাযথ অভ্যাস করতে পেরেছেন, তিনি উভয়েরই ফল পাবেন। (5.04)
সন্ন্যাসী যে লক্ষ্যে পৌঁছায় কর্মযোগীও একই লক্ষ্যে পৌঁছায়। অতএব, যিনি
ত্যাগের পথ এবং নিষ্কাম কর্মের পথকে একই মনে করেন, তিনি সত্যদ্রষ্টা। (এছাড়াও দেখুন 6.01 এবং 6.02) (5.05) কিন্তু, হে অর্জুন, কর্মযোগ ব্যতীত প্রকৃত ত্যাগ প্রাপ্ত করা যায় না। যে সাধু
কর্মযোগ অভ্যাস করেন তিনি দ্রুত ব্রহ্মের শরণ পান। (এছাড়াও দেখুন 4.31, এবং 4.38) (5.06) একজন কর্মযোগী,
যার মন শুদ্ধ, যা ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রিত এবং সকল জীবে ঈশ্বরকে দেখেন, তিনি কর্মযোগ
দ্বারা আবদ্ধ নন। (5.07) একজন কর্মযোগী
ঈশ্বরের কাজ করেন যে
জ্ঞানী (অথবা সন্ন্যাসী) সত্যি জানেন তিনি মনে করেন: "আমি কিছুই করি না ". দর্শন, শ্রবণ,
স্পর্শ, ঘ্রান, ভোজন, গমন, নিদ্রা, শ্বসন; এবং কথা বলা, দেওয়া, নেওয়া, চোখ খোলা এবং বন্ধ করার
সময়, একজন
সন্ন্যাসী বিশ্বাস করেন যে শুধুমাত্র ইন্দির্যগুলি বস্তুর উপর কাজ করছে। (এছাড়াও দেখুন 3.27, 13.29, এবং 14.19) (5.08-09) যিনি সর্ব কর্ম ঈশ্বরকে নিবেদন করেন ---
ফলাফলের প্রতি স্বার্থপর আসক্তি ত্যাগ
করেন --- তাঁকে
কর্মফল অথবা পাপ ছুঁতে পারেনা, ঠিক যেমন পদ্মের পাতায় জল স্পর্শ করেনা। (5.10)
কর্মযোগীরা তাদের শরীর, মন, বুদ্ধি, এবং ইন্দ্রিয় দিয়ে স্বার্থপর আসক্তি ছাড়া
শুধুমাত্র আত্মশুদ্ধির জন্য কর্ম করেন। (5.11) একজন
কর্মযোগী কর্মফলের প্রতি আসক্তি পরিত্যাগ করে প্রকৃত শান্তি লাভ করেন;
যেখানে অন্যরা, যারা কর্মফলের প্রতি
আকৃষ্ট, তারা স্বার্থযুক্ত কাজের জন্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়। (5.12)
যে
ব্যক্তি সমস্ত কর্মফলকে পরিত্যাগ করেছেন, তিনি কোন কর্ম না করে এবং কাউকে দিয়ে কোন
কর্ম না করিয়ে সুখে কালাতিপাত করেন। (5.13) প্রভু কখনও কর্মের প্রতি প্রেরণা সৃষ্টি
করেন না, কিছু করার অনুভূতি সৃষ্টি করেন না, এবং কর্মফলের প্রতি আসক্তিও সৃষ্টি
করে না। এগুলি সমস্তই প্রাকৃতিক গুণাবলীর কারণে ঘটে। (5.14) পরমেশ্বর ভগবান
জীবের ভালো অথবা খারাপ কাজের দায়িত্ব নেন না। আত্ম-জ্ঞান অজ্ঞানতার মোহে আচ্ছন্ন
হয়ে থাকে, এবং তাই মানুষ বিভ্রান্ত হয় (এবং খারাপ কাজ করে)। (5.15) অতীন্দ্রিয় জ্ঞান
নিজের প্রতি অজ্ঞানতা নাশ করে এবং পরমেশ্বরের সন্ধান দেয়, ঠিক যেমন সূর্যের আলো
পৃথিবীর সৌন্দর্য উদ্ভাসিত করে। (5.16) যে ব্যক্তির মন এবং
বুদ্ধি ব্রহ্মময় (চিরন্তন সত্তা), যিনি সদাই ব্রহ্মে নিবেদিত, যিনি ব্রহ্মাকে
নিজের পরম লক্ষ্য এবং একমাত্র আশ্রয় হিসাবে মনে করেন, এবং ব্রহ্মজ্ঞানে যাদের
কলুষতা নষ্ট হয়ে গেছে, তারা আবার জন্মগ্রহণ করেন না। (5.17)
জ্ঞানী ব্যক্তির অতিরিক্ত লক্ষণ একজন জ্ঞানী ব্যক্তি (ভগবানকে দেখে) একজন শিখিত এবং দরিদ্র ব্রাহ্মন, একজন সমাজচ্যুত,
এমনকি একটি গরু, একটি হাতি, অথবা একটি কুকুরকেও একই চোখে দেখে। (এছাড়াও দেখুন 6.29) (5.18) এই জীবনে
সেই ব্যক্তি সমস্তকিছু পেয়েছেন যিনি সমানতায় বিশ্বাস করেন। এই ধরণের মানুষ চিরন্তন
সত্তাকে উপলব্ধি করে কারণ চিরন্তন সত্তা নির্দোষ এবং নিরপেক্ষ। (এছাড়াও দেখুন 18.55) (5.19) যিনি প্রিয়
বস্তুর প্রাপ্তিতে আনন্দ পান না, অপ্রিয় অবস্থার সৃষ্টিতে দুঃখ পান না, যিনি
স্থিরচিত্ত, যিনি মোহান্ধ নন, এবং যিনি চিরন্তন সত্তাকে জানেন, যেমন ব্যক্তি
চিরকাল ব্রহ্মার শরণে থাকেন। (5.20) Such ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম সেই ব্যক্তি বাহ্যিক শারীরিক
সুখের থেকে অনাসক্ত হয়ে যান মননের মাধ্যমে আত্ম আনন্দ আবিষ্কার করে এবং অতীন্দ্রিয়
সুখ উপভোগ করেন। (5.21) প্রকৃতপক্ষে,
ইন্দ্রিয়গত সুখ দুঃখের কারণ, এটির শুরু এবং শেষ আছে। অতএব, হে অর্জুন, জ্ঞানী
ব্যক্তি ইন্দ্রিয়সুখে আনন্দ পান না। (এছাড়াও দেখুন 18.38) (5.22) মৃত্যুর পূর্বে যিনি কাম এবং ক্রোধের
প্রবৃত্তি দমন করতে পারেন, তিনিই যোগী, এবং একজন জ্ঞানী ব্যক্তি। (5.23) যিনি চিরন্তন
সত্তার সঙ্গে আনন্দ খুঁজে পান, যিনি অন্তরের চিরন্তন সত্তাকে নিয়ে খুশী হন, এবং
যিনি আত্ম-জ্ঞানে উদ্ভাসিত, তেমন যোগী ব্রহ্মনির্বাণ লাভ করেন, এবং পরমাত্মায়
বিলীন হন। (5.24) যে
ব্যক্তির পাপ (অথবা অপগুণগুলি) বিনষ্ট হয়েছে, যিনি আত্ম-জ্ঞানে সংশয় দূর করেছেন,
যান মন সংযত, যিনি সর্বকল্যানে সদা রত, তিনি পরমাত্মাকে লাভ করেন। (5.25) যারা কাম এবং ক্রোধ থেকে মুক্ত,
যাদের মন এবং ইন্দ্রিয় দমিত, এবং যাদের আত্ম-জ্ঞান আছে, তাদের সহজেই ব্রহ্মনির্বাণ
প্রাপ্তি হয়। (5.26) তৃতীয় পথ --- ভক্তিপূর্ণ ধ্যান এবং মননের পথ বাহ্যিক
সমস্ত সুখ থেকে মনকে মুক্ত করে, দুই ভ্রূ এর মাঝখানে মনকে স্থির করে, নাসিকার
মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত বায়ুর ভারসাম্য বজায় রেখে, ইন্দ্রিয়, মন, এবং বুদ্ধিকে
নিয়ন্ত্রণে রেখে, মুক্তিকে প্রাথমিক লক্ষ্য হিসাবে ধরে একজন ঋষি কাম, ক্রোধ, এবং
ভয় থেকে মুক্ত হয়ে যান। (5.27-28)
আমার ভক্তেরা আমাকে (অথবা কৃষ্ণ, পরমশ্বর ভগবান) যজ্ঞ এবং তপস্যার
উদ্দেশ্যস্বরূপ জেনে, জগতের পরম প্রভু জেনে, এবং সমস্ত জীবের সুহৃদ হিসাবে জেনে
শান্তি পায়। (5.29) 6. ধ্যানের পথ পরমেশ্বর
ভগবান বললেন: যিনি
ফলের আশা না করে (ব্যক্তিগত উপভোগের আশা না রেখে) কর্তব্যকর্ম সম্পাদন করেন তিনিই
একজন ত্যাগী (সন্ন্যাসী) এবং একজন কর্মযোগী। শুধুমাত্র অগ্নিহোমআদি করে সন্ন্যাসী
হওয়া যায় না, শুধুমাত্র কর্ম থেকে বিরত থেকেই যোগী হওয়া যায় না। (6.01) হে অর্জুন, তারা যাকে ত্যাগ
বলে (সন্ন্যাস) তাই কর্মযোগ
হিসাবে পরিচিত। যিনি স্বার্থের জন্য কর্ম সম্পাদন করা ত্যাগ করতে পারেন না তিনি
কর্মযোগী হতে পারেন না। (এছাড়াও
দেখুন 5.01, 5.05, 6.01, এবং 18.02) (6.02) যিনি
(ধ্যানের, অথবা মনের প্রশান্তির) যোগ প্রাপ্ত করতে চান তেমন জ্ঞানীর জন্য, কর্মযোগ অনুষ্ঠান
শ্রেয়। যিনি যোগ প্রাপ্ত করেছেন, তাদের জন্য প্রশান্তি আত্ম-উপলব্ধির উপায় হয়ে ওঠে। একজন
ব্যক্তির যোগ সংক্রান্ত পরিপূর্ণতা আছে বলে মনে করা হয় যখন তার ইন্দ্রিয়সুখের কোন
কামনা নেই অথবা কর্মফলের প্রতি আসক্তি নেই, এবং যিনি সমস্ত ব্যক্তিগত স্বার্থ
বিসর্জন দিয়েছেন। (6.03-04) নিজ মনের সাহায্যে মানুষের উন্নতি করা উচিৎ, অধঃপতন হওয়া উচিৎ নয়। মন একাই মানুষের বন্ধু এবং শত্রু। যাদের মন নিয়ন্ত্রণে
আছে তাদের জন্য এটি বন্ধু, যাদের মন নিয়ন্ত্রণে নেই তাদের জন্য এটি শত্রুর ন্যায়
আচরণ করেন। (6.05-06) যিনি নিজের মন এবং ইন্দ্রিয়ের উপর
জয় প্রাপ্ত করেছেন তিনি শীত এবং গ্রীষ্ম, সুখ এবং দুঃখ, সম্মান এবং অপমানে সমান
ভাবে অবিচলিত থাকেন নিজ পরমেশ্বরের সঙ্গে। (6.07) সেই ব্যক্তিকে যোগী বলা হয় যার আত্ম-জ্ঞান
এবং আত্ম-উপলব্ধি আছে, যিনি শান্ত, যার মন এবং ইন্দ্রিয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ আছে, এবং
যার কাছে, মৃত্তিকা, প্রস্তর, এবং স্বর্ণ সমান জ্ঞান হয়। (6.08) যে ব্যক্তি সুহৃদ, বন্ধু, শত্রু, উদাসীন, মধ্যস্ত, মৎসর, আত্মীয়, ধার্মিক, এবং পাপী সবার প্রতি সমান নিরপেক্ষ
থাকেন তাঁকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করা হয়। (6.09) একজন
যোগী, সর্বদা একান্তে অবস্থিত হয়ে মনকে ঈশ্বরমুখী করবেন, মন এবং ইন্দ্রিয়কে
নিয়ন্ত্রণে রাখবেন এবং কামনা এবং অধিকারবোধ মুক্ত অবস্থায় থাকবেন। (6.10) যোগী কুশাসনের
উপর মৃগচর্ম এবং একটি বস্ত্রখণ্ড রেখে, পরিষ্কার স্থানে অত্যন্ত উচ্চ বা নীচ নয়
এমন দৃঢ় আসনে আসীন হবেন। সেখানে আরামদায়কভাবে উপবিষ্ট হয়ে ইশ্বরে মনকে স্থির করে,
চিন্তা এবং ইন্দ্রিয়ের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করে, আত্মশোধনের জন্য ধ্যান অভ্যাস
করবেন। (6.11-12) কটি,
মেরুদণ্ড, বক্ষ, গ্রীবা এবং মস্তক সরল রেখায় রেখে, নিশ্চল এবং স্থির হয়ে বসে; চারিদিকে
দৃষ্টিনিক্ষেপ না করে চোখ এবং মনকে নাসিকার অগ্রভাগে নিবদ্ধ করে; মনকে শান্ত এবং
ভয়হীন করে; ব্রহ্মচর্য
পালন করবেন; মনকে
নিয়ন্ত্রণে রাখবেন; আমার কথা
চিন্তা করবেন; এবং
আমাদেই পরম উদ্দেশ্যজ্ঞানে লাভ করবেন। (এছাড়াও দেখুন 4.29, 5.27, 8.10, এবং 8.12) (6.13-14) অতএব, সর্বদা আমার মধ্যে মনকে নিবদ্ধ
রাখার অনুশীলন দ্বারা, চিত্ত নিয়ন্ত্রিত যোগী ব্রহ্মনির্বাণের শান্তি পাবে এবং
আমার কাছে আসবে। (6.15) হে অর্জুন, যিনি অধিক ভোজন করেন, যিনি যথেষ্ট ভোজন করেন না;
যিনি বেশী ঘুমান অথবা যিনি জেগে থাকেন তার দ্বারা এই যোগ সম্ভব নইয়। (6.16) কিন্তু যিনি পরিমিত আহার, বিহার,
কর্ম, ঘুম, এবং জাগরণে থাকেন তার ক্ষেত্রে ধ্যান যোগ সর্বদুঃখহারক হয়। (6.17) একজন ব্যক্তির
যোগ প্রাপ্তি হয়েছে, পরমেশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে বলা হয় যখন সম্পূর্ণ সুশৃঙ্খল
মন সমস্ত কামনা থেকে মুক্ত হয়ে ব্রহ্মের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে একাত্ম হয়ে যায় সমাধি
(ধ্যান) এর মাধ্যমে। (6.18)
বায়ু থেকে আড়াল (পরমেশ্বর দ্বারা) একটি দীপ যেমন বায়ুস্রোতে (কামনার) কম্পিত
হয় না; ভগবানের
ধ্যানে মগ্ন চিত্তবৃত্তির নিয়ন্ত্রণ অভ্যাসকারী যোগীর চিত্তও অবিচলিত থাকে। (6.19) যোগ অভ্যাসের ফলে মন যখন স্থির হয়, শুদ্ধ চিত্তে পরমেশ্বরকে
ধারণ করে মানুষ শান্তি লাভ করে। (6.20) যোগী অসীম সুখ অনুভব করে যা শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তি দ্বারা
উপলব্ধি করা যায়, যা ইন্দ্রিয়ের সীমার বাইরে। একবার পরমেশ্বরকে উপলব্ধি করার পর,
যোগী কখনই পরম বাস্তব থেকে পৃথক হন না। (6.21) আত্ম-উপলব্ধির পর, আর কোন প্রাপ্তি
আত্ম-উপলব্ধির থেকে শ্রেয় হয় না। আত্ম-উপলব্ধ অবস্থায় যোগী চরম বিপর্যয়েও অবিচলিত
থাকেন। (6.22) জড়দুঃখের
সঙ্গে যোগাযোগ নষ্ট হওয়ার অবস্থাকেই যোগ বলা হয়। এই যোগ দৃঢ় সংকল্প এবং কোনরকম
মানসিক সংরক্ষণ ছাড়াই অভ্যাস করা উচিৎ। (6.23) সকল স্বার্থযুক্ত
কামনা বর্জন করে, বুদ্ধির দ্বারা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু থেকে ইন্দ্রিয়গুলিএ
সম্পূর্ণরূপে নিবৃত্ত করে, সুপ্রশিক্ষিত এবং শুদ্ধ বুদ্ধির দ্বারা মন চিরন্তন
সত্তার চিন্তায় ক্রমাগত নিমজ্জিত রেখে, এবং আমার কথা চিন্তা করে যোগী ক্রমাগত মনের
প্রশান্তি লাভ করেন। (6.24-25)
ধ্যানের সময় এই অস্থির এবং অদৃঢ় মন যে
বিষয়েই ধাবিত হোক, যোগীর উচিৎ এটিকে নিবৃত্ত করে নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। (6.26)
আত্ম-উপলব্ধ
যোগীর মধ্যে পরম সুখ আসে, যার মন শান্ত, যার কামনা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, এবং যিনি পাপ
(অথবা ত্রুটি) থেকে মুক্ত। (6.27) তেমন একজন পাপহীন যোগী, যিনি ক্রমাগত তার মন এবং বুদ্ধি
চিরন্তন সত্তার সংস্পর্শে নিয়ে আসেন, তিনি সহজের ব্রহ্মস্পর্শের অসীম সুখ অনুভব
করেন। (6.28) সর্বত্র বিরাজমান চিরন্তন সত্তাকে সমস্ত জীবে
উপলব্ধি করে এবং সমস্ত জীবের মধ্যে বিরাজমান চিরন্তন সত্তাকে উপলব্ধি করে;
একজন যদি, যিনি চিরন্তন সত্তার সঙ্গে
একাত্ম হয়েছে, তিনি সবাইকে সমান চোখে দেখেন। (এছাড়াও দেখুন 4.35, 5.18) (6.29) যিনি সর্বভূতে আমাকে দর্শন করেন এবং আমার মধ্যে
সমস্ত বস্তুর দর্শন পান, তিনি কখনও আমার থেকে আলাদা হন না, এবং আমিও কখনও তার থেকে
পৃথক হই না। (6.30) যে অদ্বৈতবাদীরা সমস্ত জীবের মধ্যে আমার
উপাসনা করেন, তারা তাদের জীবনযাত্রার পদ্ধতি নির্বিশেষে আমার মধ্যে থাকেন। (6.31) হে অর্জুন, তাকেই যোগীশ্রেষ্ঠ বিবেচনা করা হয় যিনি
প্রত্যেককে নিজের মতো সম্মান করেন এবং জিনিস অন্যদের সুখ এবং দুঃখকে নিজের বলে বোধ
করতে পারেন। (6.32) মনকে নিয়ন্ত্রণ করার দুটি পদ্ধতি অর্জুন
বললেন: হে কৃষ্ণ, আপনি বললেন
ধ্যানযোগের প্রধান চিহ্ন মনের প্রশান্তি, কিন্তু আমার মন অস্থির থাকায়, আমি চিত্ত
স্থির করতে পারছিনা। কারণ আমার মন, বাস্তবেই খুবই অস্থির, অশান্ত, শক্তিশালী, এবং
অবাধ্য, হে কৃষ্ণ। আমার মনকে নিয়ন্ত্রণ করা বায়ুকে সংযত করার মতোই কঠিন। (6.33-34) পরমেশ্বর ভগবান বললেন: হে অর্জুন, নিঃসন্দেহে মন অশান্ত এবং তাঁকে
নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন, কিন্তু অধ্যাবসায়ের থাকে ক্রমাগত বহু আধ্যাত্মিক অনুশীলন এবং
অনাসক্তি দ্বারা এটিকে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। (6.35) আমার
মতে, যার মন নিয়ন্ত্রণে নেই তার জন্য যোগ কঠিন। যদিও, যার মন সংযত এবং যিনি যথার্থ
উপায় অবলম্বন করে মনকে বশ করার চেষ্টা করেন তিনি অবশ্যই যোগে সিদ্ধিলাভ করেন। (6.36) অর্জুন
বললেন: অনিয়ন্ত্রিত
মনের কারণে যে শ্রদ্ধাবান যোগের পথচ্যুত যোগের সিদ্ধি লাভ করতে অপারগ হন --- তেমন ব্যক্তির
জন্য কোন মার্গ উন্মুক্ত থাকে, হে কৃষ্ণ? (6.37) হে কৃষ্ণ, তিনি কি ছড়িয়ে পড়া মেঘের মতো
বিনষ্ট হয়ে যাবেন না, উভয় (ভোগ এবং যোগ, আধ্যাত্মিক এবং জাগতিক সুখ) হারাবেন না,
আত্ম-উপলব্ধির পথে অবলম্বনহীন এবং বিমূঢ় হয়ে পড়বেন না? (6.38) হে কৃষ্ণ, কেবল
আপনিই পারেন আমার এই সংশয় সম্পূর্ণ দূর করতে, কারণ আপনি ছাড়া আর কেউ এই সংশয় দূর
করতে পারবেন না। (এছাড়াও
দেখুন 15.15) (6.39) পরমেশ্বর
ভগবান বললেন: হে
অর্জুন, একজন যোগীর ইহলোকে অহতবা পরলোকে কোন দুর্গতি হয় না। অতীন্দ্রিয়বাদীকে কোন
কষ্ট ভোগ করতে হয় না, আমার প্রিয় বন্ধু। (6.40) অসফল যোগী বহু বছর ধরে স্বর্গবাসের পরে কোন ধার্মিক এবং
সমৃদ্ধ গৃহে পুনর্জন্ম নেন,
অথবা তেমন যোগী কোন জ্ঞানবান যোগীর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এই ধরণের জন্ম, এই
পৃথিবীতে প্রাপ্ত করা, অবশ্যই কঠিন। (6.41-42) হে অর্জুন, সেখানে তিনি আগের জন্মে
প্রাপ্ত করা জ্ঞানগুলি পুনরুদ্ধার করেন এবং আরও একবার সিদ্ধিলাভের চেষ্টা করেন। (6.43) The বিফল
যোগী আগের জন্মের যোগ অভ্যাসের (সংস্কার) বশত চিরন্তন সত্তার দিকে আকৃষ্ট হন।
এমনকি যোগ --- ভগবানের সঙ্গে একাত্মতা --- এই সমস্ত ব্যাপারে জিজ্ঞাসু হন এবং
বৈদিক আচার আচরণ পালনকারীদের থেকে এগিয়ে থাকেন। (6.44) যে যোগী
নিরলস প্রচেষ্টা করে যান, যিনি সমস্ত পাপ (অথবা ত্রুটি) থেকে মুক্ত সম্পূর্ণ
মুক্তি পান বহু জন্মের ক্রমাগত প্রচেষ্টার ফলে, এবং ভগবানের ধামে পৌঁছান। (6.45) যোগী
তপস্বীদের থেকে শ্রেষ্ঠ। যোগী বেদজ্ঞদের থেকে শ্রেষ্ঠ। যোগী সকাম আচারনিষ্ঠ
ব্যক্তি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। অতএব, হে অর্জুন, তুমি যোগী হও। (6.46) I যিনি
প্রেম এবং শ্রদ্ধা সহকারে পরম বিশ্বাসে আমার ধ্যান করেন, এবং যার মন সদা আমার
সঙ্গে যুক্ত থাকে, তাকেই আমি সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী জ্ঞান করি। (এছাড়াও দেখুন 12.02 এবং 18.66) (6.47) 7. আত্ম জ্ঞান এবং উপলব্ধি পরমেশ্বর
ভগবান বললেন: হে
অর্জুন, মনকে আমাতে কেন্দ্রীভূত রেখে, আমাতে মনোনিবেশ করে, যোগ অভ্যাস দ্বারা
কিবাহবে আমাকে কোন সংশয় ছাড়া সম্পূর্ণরূপে জানবে তা শ্রবণ করো। (7.01) আমি এখন তোমাকে
আত্ম-জ্ঞান প্রদান করবো, আত্ম-উপলব্ধির সঙ্গে, যা জানার পরে পৃথিবীতে আর জানার
কিছু থাকে না। (7.02) হাজার
হাজার মানুষের মধ্যে কদাচিৎ কোন একজন
আত্ম-উপলব্ধির সিদ্ধিলাভের প্রচেষ্টা করেন। হাজার হাজার সিদ্ধপুরুষের মধ্যে কদাচিৎ কোনএকজন প্রকৃতভাবে আমাকে বোঝেন। (7.03) বস্তু, চেতনা, এবং আত্মার সংজ্ঞা মন,
বুদ্ধি, অহংকার, আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল, এবং মাটি এই আটটি আমার জড়শক্তি (প্রকৃতি)
এর অষ্টধা রূপান্তর। (এছাড়াও
দেখুন 13.05) (7.04) জড় শক্তি আমার নিকৃষ্ট প্রকৃতি। আমার অন্য উৎকৃষ্ট প্রকৃতি হছে পুরুষ প্রকৃতি, হে অর্জুন, যা এই
সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের আধার। (7.05) এই দ্বৈত শক্তি থেকে সমগ্র প্রাণীকুলের উৎপত্তি; এবং আমি --- পরমেশ্বর (পরাব্রহ্ম, কৃষ্ণ) --- আমি জগতের উৎপত্তির উৎস, এবং সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের ধ্বংসের কারণ। (এছাড়াও দেখুন 13.26) (7.06) হে অর্জুন, আমার থেকে উচ্চ কিছু নেই। যেমন কণ্ঠহারে সুতোর
দ্বারা রত্নাবলী গাঁথা থাকে, ব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুই আমার দ্বারা সংযুক্ত, আমি
পরমেশ্বর। (7.07) হে অর্জুন, আমি জলের সরসতা, আমি সূর্য এবং
চন্দ্রের প্রভা, আমি সমস্ত বেদের পবিত্র ‘ওম’ ধ্বনি, আমি আকাশের শব্দ, আমি মানুষের
শক্তি। আমি মাটির মিষ্টি গন্ধ। আমি অগ্নির উষ্ণতা, আমি সমগ্র জীবজগতে প্রানের স্পন্দন,
এবং আমি তপস্বীদের তপ। (7.08-09)
হে অর্জুন, আমাকে সমস্ত জীবের চিরন্তন বীজ হিসাবে জানবে। আমি বুদ্ধিমানের
বুদ্ধি, এবং তেজস্বীর তেজ। (এছাড়াও দেখুন 9.18 এবং 10.39). আমি কাম এবং স্বার্থযুক্ত আসক্তিমুক্ত শক্তিমানের শক্তি।
ধর্মানুযায়ী কাম (কামদেব) হিসাবে আমি মনুষ্যের মধ্যে বিরাজমান (বিবাহের পরে
শুধুমাত্র সন্তানাদি প্রাপ্তির পবিত্র কারণের জন্য), হে অর্জুন। (7.10-11) জড় প্রকৃতির তিন
গুন, সত্ত্ব, রজ, এবং তম --- আমার থেকেই উৎপন্ন হয় বলে জানবে। আমি নিজে এই গুণগুলির অধীন নই, কিন্তু এই গুণগুলি আমার উপর
নির্ভরশীল। (এছাড়াও
দেখুন 9.04 এবং 9.05) (7.12) মনুষ্য জড় জগতের
এই তিন গুণের বহু পরিপ্রেক্ষিত দ্বারা মোহান্ধ হয়ে থাকে; তাই তারা আমাকে জানেনা,
আমি শাশ্বত এবং সর্বগুণের অতীত। (7.13) আমার এই দৈব শক্তি (মায়া), জড় প্রকৃতির তিনটি গুন থেকে সৃষ্ট,
এটি অতিক্রম করা খুবই কষ্টকর।
শুধুমাত্র যারা আমাতে নিজেকে সমর্পণ করেন তারা সহজেই এই মায়ার বন্ধন এড়াতে পারেন। (এছাড়াও দেখুন 14.26, 15.19, এবং 18.66) (7.14) দুষ্কৃতিকারী,
মূঢ়, নরাধম যারা আসুরিক প্রকৃতির সঙ্গে সংযুক্ত এবং মায়ার দ্বারা যাদের পার্থক্য
বোঝার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে তারা আমার পূজা করেন না অথবা আমাকে খোঁজেন না। (7.15) হে অর্জুন, চার
ধরণের পুণ্য ব্যক্তি আমার স্মরণ নেন। তারা হলেন: আর্ত, আত্ম-জ্ঞান সন্ধানি, অর্থ সন্ধানী, এবং জ্ঞানী
যিনি পরমাত্মাকে জানেন। (7.16) এর মধ্যে জ্ঞানী
ভক্ত, যিনি আমার সঙ্গে মিলিত হয়েছে এবং যিনি একনিষ্ঠ ভক্তি রাখেন, তিনি শ্রেষ্ঠ, কারণ জ্ঞানীর
কাছে আমি প্রিয়, এবং আমার কাছে জ্ঞানী প্রিয়। (7.17) এই সমস্ত ভক্তেরাই মহাত্মা, কিন্তু জ্ঞানী
ভক্তকে আমি নিজের মতোই সম্মান করি। একনিষ্ঠ ভক্ত আমার সঙ্গে একাত্ম হন এবং আমাকে
লাভ করেন। (এছাড়াও
দেখুন 9.29) (7.18) বহু জন্মের পরে জ্ঞানী উপলব্ধি করেন সমস্ত কিছুই
আমার (পরমাত্মার) প্রকাশ এবং আমাতে আত্মসমর্পণ করেন। এমন মহান আত্মার দেখা পাওয়া
বিরল। (7.19) যেসমস্ত মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি বিভিন্ন
কামনাবাসনার জন্য হারিয়ে গেছে, তারা বিভিন্ন দেবদেবীর শরনাগত হয় এবং তাদের স্বীয়
স্বভাব (সংস্কার) অনুযায়ী বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। (7.20) ভগবানকে পুজো করার জন্য যেকোনো পছন্দসই রূপে দেখা যায় যে দেবতার পুজো করার ইচ্ছা (যেকোনো নাম, রূপ, অথবা
পদ্ধতি) মানুষ রাখে, আমি সেই দেবতায় তার ভক্তি অচঞ্চল রাখি। অচঞ্চল ভক্তির ফলে,
তারা সেই দেবতাকে পুজো করে এবং সেই দেবতার মাধ্যমে তাদের ইচ্ছাপূরণ হয়। সেই
ইচ্ছাগুলি, অবশ্যই, আমার দান। (7.21-22) ক্ষুদ্রবুদ্ধি এই
মানুষগুলির প্রাপ্ত করা পার্থিব লাভগুলি ক্ষণস্থায়ী। দেবতাদের ভক্তরা দেবতাদের লোক
প্রাপ্ত হন, কিন্তু আমার ভক্তরা শুধুমাত্র আমার পরম ধামে আসেন। (7.23) মূঢ় ব্যক্তি ---
যারা আমার অপরিবর্তনীয়, অতুলনীয়,
অবোধ্য, এবং অতীন্দ্রিয় রূপ (অথবা অস্তিত্ব) বুঝতে পারে না ---
তারা মনে করে
আমি, পরমেশ্বর, আমার কোন রূপ নেই এবং আমি এই রূপ ধারণ করেছে। (7.24)
আমার দৈব ক্ষমতা (মায়া) এর আড়ালে
লুকিয়ে, আমি
মূঢ় ব্যক্তির কাছে নিজেকে প্রকাশ করিনা, যিনি আমার অজাত, শাশ্বত, এবং অতীন্দ্রিয় রূপ এবং
ব্যক্তিত্ব বুঝতে পারেন না (এবং আমার রূপহীন মনে করেন)। (7.25)
হে অর্জুন, আমি অতীত, বর্তমান, এবং
ভবিষ্যৎ সমস্তই জানি, কিন্তু আমাকে কেউই জানেনা। (7.26) হে অর্জুন,
অনুকূল বিষয়ে ইচ্ছা এবং প্রতিকুল বিষয়ে দ্বেষ থেকে দ্বন্দ্ব ভাবের উদ্ভব হয়, যার
প্রভাবে এই জগতের সকল জীব মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু যেসমস্ত মানুষের নিঃস্বার্থ
কর্ম, যাদের কর্মফল অথবা পাপ সম্পূর্ণ দূর হয়েছে, তারা এই দ্বন্দ্ব এবং মোহ থেকে
মুক্ত হয়, এবং দৃঢ় নিষ্ঠার সঙ্গে আমাকে পুজো করেন। (7.27-28) যারা জন্মচক্রের বন্ধন, বার্ধক্য, এবং
মৃত্যুর থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য প্রচেষ্টা করে যারা আমার শরণে আসেন , তারা
সম্পূর্ণরূপে ব্রহ্মা (চিরন্তন সত্তা), ব্রহ্মের প্রকৃতি, এবং কর্ম, ব্রহ্মের
ক্ষমতাকে সম্পূর্ণরূপে বোঝেন। (7.29) যে দৃঢ়চিত্ত মানুষ আমাকে মরণশীল ব্যক্তি, সাময়িক দৈব
উপস্থিতি এবং পরমাত্মা হিসাবে জানেন, তারা এমনকি মৃত্যুর সময়েও, আমার শরনাগত হন। (এছাড়াও দেখুন 8.04) (7.30) 8. চিরন্তন সত্তা অর্জুন বললেন: হে কৃষ্ণ চিরন্তন সত্তা কে? চিরন্তন সত্তার প্রকৃতি কি? কর্মফল কি? মরণশীল প্রাণী
কারা? দৈব সত্তা কারা? পরমাত্মা কে, এবং তিনি কিভাবে আমাদের শরীরে বাস করেন? হে কৃষ্ণ, যাদের
মনের উপর নিয়ন্ত্রণ আছে মৃত্যুর সময় তারা কিভাবে আপনাকে মনে করবে? (8.01-02) পরমাত্মা, আত্মা, জীবাত্মা এবং কর্মফলের সংজ্ঞা পরমেশ্বর ভগবান বললেন: অপরিবর্তনীয় আত্মা (জীব) কে বলা হয় ব্রহ্মা (চিরন্তন সত্তা). ব্রহ্মের প্রকৃতি (যার অন্তর্গত জ্ঞান এবং ইচ্ছার
সহজাত শক্তি) কে বলা হয় আধ্যাত্ম। The creative power of
Brahma that causes manifestation of the living entity is called Karma. (8.03) মরণশীল
জীবকে বলা হয় অধিভুত। দৈব ব্যক্তিত্বের বিস্তারগুলি ---যেমন নারায়ন, মহাবিষ্ণু,
ঈশ্বর প্রভৃতি --- কে বলা
হয় দেবতা। দেহান্তরগত অন্তর্যামী পুরুষরূপে আমিই পরম দেবতা, হে অর্জুন। (8.04) এমনকি
মৃত্যুর সময়েও যে আমাকে স্মরণ করে, সে তৎক্ষণাৎ আমার ভাব
প্রাপ্ত করে; এই
ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। (8.05)
হে অর্জুন, জীবনের শেষে যে বস্তুর কথা
স্মরণ করে কেউ দেহত্যাগ করে সে সেই বস্তুকেই অর্জন করে, সেই বস্তুর ক্রমাগত
চিন্তার ফলে (মানুষ
জীবনের শেষে যে বস্তুর চিন্তা করে সেটিকেই অর্জন করে).
(8.06) ঈশ্বরকে উপলব্ধি করার সরল পদ্ধতি অতএব, সর্বদা আমাকে স্মরণে রেখে নিজ কর্তব্য করো।
যদি তোমার মন এবং বুদ্ধি আমাতে সংবদ্ধ থাকে তাহলে তুমি অবশ্যই আমাকে প্রাপ্ত করবে।
(8.07) হে অর্জুন, যোগ অভ্যাসে অভ্যস্ত একনিষ্ঠ মনে আমার ধ্যান
করলে, পরমাত্মাকে পাওয়া যায়। (8.08) যিনি পরমাত্মার ধ্যান করেন --- সর্বজ্ঞ, সনাতন, নিয়ন্তা, সূক্ষ্ম থেকে
সূক্ষ্মতর (এবং বৃহৎ থেকে বৃহত্তর),
সকলের পালনকর্তা, অচিন্ত্য, সূর্যের মতো জ্যোতির্ময়, এবং অতীন্দ্রিয় বা পার্থিব জগতের
অতীত হিসাবে --- একনিষ্ঠ
মন এবং নিষ্ঠার সহিত এমনকি মৃত্যুর সময়েও; যোগ অভ্যাসের দ্বারা জৈবপ্রেরণা (জীবনীশক্তি, প্রাণ)
কে দুই ভ্রূয়ের মধ্যবর্তী স্থানে (অথবা ষষ্ঠ চক্র) তুলে এবং সেখানে অবস্থান করিয়ে,
কৃষ্ণ, পরমেশ্বর ভগবানকে পাওয়া যায়। (এছাড়াও দেখুন 4.29, 5.27, 6.13) (8.09-10) বেদজ্ঞানী
মানুষেরা যাকে বলেন নির্বিকার; বিষয়াসক্তিশুন্য সন্ন্যাসীরা যাকে লাভ করেন; এবং
ব্রহ্মচারীরা যাকে লাভ করার ইচ্ছায় ব্রহ্মচর্য পালন করেন, তাঁর কথা আমি তোমায়
সংক্ষেপে বলবো। (8.11) মৃত্যুর সময়ে ভগবানের চিন্তায় মনস্থির করে মুক্তি পান যখন কেউ ইন্দ্রিয়গুলি নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে,
মস্তিস্কে ভগবান এবং প্রাণ (জীবনীশক্তি) এর উপর চিন্তাকে কেন্দ্রীভূত করে, যোগ
অভ্যাসে রত হয়েছে, আমার উপর ধ্যান রেখে ওম শব্দের উচ্চারণ করতে করতে প্রাণ ত্যাগ
করেন --- যা
চিরন্তন সত্তার পবিত্র একমাত্রিক শব্দ --- তাঁর স্বর্গ প্রাপ্তি হয়। (8.12-13)
আমাকে সহজেই প্রাপ্ত করা যায়, হে
অর্জুন, সেই সর্বদা একনিষ্ঠ যোগীর দ্বারা জিনিস সর্বদা আমার কথাই ভাবেই এবং যার মন
আর কোথাও যায় না। (8.14) একবার আমাকে
প্রাপ্ত করলে, মহান আত্মারা এই দুঃখময় অস্থায়ী পৃথিবীতে পুনরায় জন্মগ্রহণ করেন না
কারণ তারা মোক্ষ প্রাপ্তি করেছেন। (8.15) সমস্ত জগতের অধিবাসীরা --- এমনকি ব্রহ্মা,
সৃষ্টিকর্তার জগতের অধিবাসীরাও --- জন্ম এবং মৃত্যুর পুনরাবৃত্তির দাস। কিন্তু হে অর্জুন,
একবার আমাকে প্রাপ্ত করলে আর পুনর্জন্ম হয় না। (এছাড়াও দেখুন 9.25) (8.16) যারা
জানেন সৃষ্টিকর্তার (ব্রহ্মা) এর একটি দিন সহস্র যুগ (অথবা 432 কোটি বছর) ব্যাপী
এবং তাঁর একটি রাত্রিও এক সহস্র যুগ ব্যাপী, তারা দিন ও রাত্রির সময়কাল জানেন। (8.17) সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার
দিনের শুরুতে সমস্ত অভিব্যক্ত বস্তু প্রাথমিক জড় প্রকৃতি (আদি প্রকৃতি) থেকে
ব্যক্ত হয়, এবং ব্রহ্মার রাত্রির শুরুতে তারা আবার একই বস্তুতে লয় প্রাপ্ত হয়। (8.18) The এইভাবে
সৃষ্টিকর্তার (ব্রহ্মা) দিনের শুরুতে সমস্ত বস্তু এবং জীব অস্তিত্ব লাভ করে;
অবধারিতভাবে সৃষ্টিকর্তার রাত্রির শুরুতে তারা লয় প্রাপ্ত হয়। (8.19)
আরও একটি চিরন্তন অতীন্দ্রিয় উপস্থিতি আছে --- যা পরিবর্তনশীল
জড় প্রকৃতির থেকে উচ্চ ---
যা সমস্ত বস্তুর সঙ্গে লয় হয় না। একে বলা হয় চিরন্তন সত্তা (ব্রহ্মা)। এটি
সমস্ত জীবের পরম গতি। যখন কেউ এটিকে প্রাপ্ত করে তখন
তাকে আর জন্ম নিতে হয় না। (8.20-21)
হে অর্জুন, পরম গতি প্রাপ্ত করা যায় আমার প্রতি অবিচল ভক্তি থাকলে, যার মধ্যে সকল
প্রাণী বাস করে এবং যিনি সর্বসংসারব্যাপী। (এছাড়াও দেখুন 9.04 এবং 11.55) (8.22) হে অর্জুন, এবার আমি প্রস্থানের বিভিন্ন পথ বর্ণনা করবো, যা
মৃত্যুর পরে যোগীরা নেন যার উপর নির্ভর করে তারা ফিরে আসেন অথবা আসেন না। (8.23)
আত্মজ্ঞান সম্পন্ন যোগীরা মৃত্যুর পরে ধীরে ধীরে অগ্নি,
আলো, দিবালোক, শুক্লপক্ষ, এবং উত্তরায়ণের নিয়ন্ত্রক দেবতাদের মাধ্যমে এগিয়ে গেলে
তারা ব্রহ্ম লাভ করেন এবং পৃথিবীতে ফেরত আসেন না। (8.24) ধার্মিক ব্যক্তিরা মৃত্যুর পরে ধীরে ধীরে ধূম, রাত্রি,
কৃষ্ণপক্ষ, দক্ষিণায়নের নিয়ন্ত্রক দেবতাদের মাধ্যমে এগিয়ে গেলে তারা স্বর্গসুখ ভোগ
করেন এবং তাঁর শেষে মর্ত্যলোকে প্রত্যাবরতন করেন। (8.25) আলোর
পথ (আধ্যাত্মিক চিন্তা
এবং আত্ম-জ্ঞান) এবং অন্ধকারের পথ (বস্তু এবং অজ্ঞানতা) কে বিশ্বের দুটি
চিরন্তন পথ বলে বিশ্বাস করা হয়। প্রথমটি নিয়ে যায় পরিত্রান (মুক্তি, নির্বাণ) এর
দিকে এবং দ্বিতীয়টি নিয়ে যায় পুনর্জন্মের দিকে। (8.26) হে
অর্জুন, এই দুটি পথকে জেনে একজন যোগী কখনই মোহগ্রস্ত হন না। অতএব, হে অর্জুন,
সর্বদা আমার সঙ্গে একনিষ্ঠ যোগে থাকো। (8.27) যে যোগী এটি জানেন তিনি বেদপাঠের সুবিধা,
যজ্ঞানুষ্ঠান, তপস্যা, এবং দান এই সবের সুবিধার থেকে অনেক ভালো ফলাফল পান এবং পরম
ধাম প্রাপ্ত করেন। (8.28)
9. পরম জ্ঞান এবং বৃহৎ
রহস্য পরমেশ্বর
ভগবান বললেন: তুমি
নিষ্ঠাবান, তাই তোমার কাছে আমি সেই জ্ঞান প্রকাশ করবো যা সবচেয়ে গভীর, গোপন, এবং
অতীন্দ্রিয়, অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতাসহ। এটি জেনে, তুমি জগতের সকল দুঃখের বন্ধন থেকে
মুক্তিলাভ করবে। (9.01) পরমাত্মার প্রকৃতির জ্ঞান সবচেয়ে বড় রহস্য আত্ম
জ্ঞান সমস্ত জ্ঞানের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, এবং এটি সবচেয়ে গোপন, খুবই পবিত্র,
এটিকে প্রবৃত্তি দ্বারা অনুভুত করা যায়, এবং ন্যায় (ধর্ম) অনুযায়ী গঠিত হয়, এটি
অভ্যাস করা অতি সহজ এবং এটি অসীম। (9.02) হে অর্জুন, যার এই জ্ঞানের উপর বিশ্বাস
নেই তিনি আমাকে প্রাপ্ত করতে পারেন না এবং ক্রমাগত জন্ম এবং মৃত্যুর চক্র অনুসরণ
করতে থাকেন। (9.03) This এই সমগ্র বিশ্ব আমার ব্যাপ্তি। সমস্ত জগত আমার উপর
নির্ভরশীল। আমি তাদের উপর নির্ভর করি না (কারণ আমি তাদের তুলনায় সর্বোচ্চ)। (এছাড়াও দেখুন 7.12) (9.04) আমার স্বর্গীয় রহস্যের ক্ষমতাকে দেখুন;
বাস্তবে, আমি ---
সমস্ত জগতের স্রষ্টা এবং পালনকর্তা ---
তাদের উপর নির্ভরশীল নই, এবং তারা
আমার উপর নির্ভরশীল নয়(9.05) (যেমন সোনার হার
সোনার উপর নির্ভরশীল, দুগ্ধজাত দ্রব্য দুগ্ধের উপর নির্ভরশীল। বাস্তবে, সোনার হার
সোনার উপর নির্ভরশীল নয়, হারটির মধ্যে শুধুমাত্র সোনাই আছে। একইভাবে বস্তু এবং
শক্তি আলাদা এবং একইসাথে আলাদা নয়). সমস্ত জীব আমার মধ্যে অবস্থান করে (কোন যোগাযোগ ছাড়া এবং কোন ফলাফল না দেখিয়ে)
যেমন মহান বায়ু সর্বত্র বিচরণশীল
কিন্তু সর্বদা আকাশে অবস্থান করে।
(9.06) হে
অর্জুন, 31 লক্ষ্য কোটি সূর্য বৎসরের একটি চক্রের শেষে সমস্ত প্রাণী আমার আদি-প্রকৃতি
(প্রাথমিক জড় প্রকৃতি) তে মিশে যাবে, এবং পরের চরের শুরুতে আমি আবার তাদেরকে প্রথম থেকে
সৃষ্টি করবো। (এছাড়াও
দেখুন 8.17) (9.07) আমি আমার
জড় প্রকৃতির সাহায্যে সমস্ত প্রাণীকে পুনঃ পুনঃ সৃষ্টি করবো। এই সমস্ত প্রাণীরা
পার্থিব প্রকৃতির অধীন থাকবে। (9.08) হে অর্জুন, এই সৃষ্টিকার্য আমার বন্ধন সৃষ্টি করে না, কারণ আমি এই
কাজগুলির ক্ষেত্রে উদাসীন এবং অপরিবর্তিত থাকে। (9.09) ঐশ্বরিক শক্তি (মায়া)--- পার্থিব প্রকৃতির
সাহায্যে --- আমার
পর্যবেক্ষণের অধীনে সমস্ত প্রাণী এবং জড়বস্তু সৃষ্টি করে; অতএব, সৃষ্টি চলতে থাকে,
হে অর্জুন। (এছাড়াও
দেখুন 14.03) (9.10) যখন আমি
মনুষ্যরূপে আবির্ভূত হই মূর্খ ব্যক্তি আমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কারণ তারা সমগ্র
জগতের প্রভু হিসাবে আমার অতীন্দ্রিয় রূপ জানেনা (এবং আমাকে সাধারণ মানুষ জ্ঞান করে), এবং তাদের মিথ্যা
আশা, মিথ্যা জ্ঞান, এবং মোহান্ধ করার মতো বন্ধু এবং আসুরিক প্রবৃত্তি থাকে (দেখুন16.04-18) (এবং তারা আমাকে
চিনতে পারেনা)। (9.11-12) কিন্তু মহান
আত্মারা, হে অর্জুন, যাদের মধ্যে স্বর্গীয় গুন
থাকে, (দেখুন 16.01-03), তারা আমাকে
অপরিবর্তনীয় হিসাবে জানে, সৃষ্টির জড় এবং দক্ষ কারক হিসাবে, এবং একচিত্ত হয়ে আমার
প্রেমপূর্ণ উপাসনা করেন। (9.13)
ব্রহ্মচর্যাদি ব্রতে দৃঢ়নিষ্ঠ ও যত্নশীল হয়ে সেই ভক্তরা সর্বদা আমার মহিমা
কীর্তন করে এবং সর্বদা ভক্তিপূর্বক আমার উপাসনা করে। (9.14) কিছু মানুষ
আত্ম-জ্ঞান প্রাপ্ত করে এবং সেগুলির প্রচারের মাধ্যমে
আমার পূজা করে। অন্যরা বহুরূপে আমার প্রকাশ (বা অদ্বৈত) হিসাবে, আমাকে বিশ্বরূপে
(অথবা দ্বৈত) এবং অন্যান্য বহু পথে আমাকে পূজা করে। (9.15) আমিই
অনুষ্ঠান, আমিই যজ্ঞ, আমিই নৈবেদ্য, আমিই ভেষজ, আমিই মন্ত্র, আমিই ঘৃত, আমিই
অগ্নি, এবং আমিই হোম। (এছাড়াও
দেখুন 4.24). আমিই
জগতের ত্রাতা, পিতাম মাতা, এবং পিতামত। আমিই সকল জ্ঞানের আধার, পবিত্র শব্দ ‘ওম’,
এবং ঋক, যজু, এবং সাম বেদ। আমিই লক্ষ্য, আমিই কারক, প্রভু, সাক্ষী, নিবাস, শরণ,
বন্ধু, উৎপত্তি, লয়,
স্থিতি, হেতু, এবং অব্যয় বীজ। (এছাড়াও দেখুন 7.10 এবং 10.39) (9.16-18) হে অর্জুন, আমিই তাপ এবং আমিই বৃষ্টি, আমি বৃষ্টি ঘটাই
এবং তা ঘটতে বাধা দি। আমি অমর এবং আমিই মৃত্যু। হে অর্জুন, আমি উভয়, পরম এবং
লৌকিক। (পরমাত্মা
সবকিছুতে রূপান্তরিত হয়েছেন। এছাড়াও দেখুন 13.12) (9.19) ভক্তি প্রেম দ্বারা মোক্ষ প্রাপ্তি বেদে
প্রস্তাবিত অনুষ্ঠানাদি পালনকারী, যারা ভক্তির অমৃত পান করেন, যাদের পাপ মুক্তি
ঘটে, যারা স্বর্গপ্রাপ্তির জন্য শুভ কর্ম সহ আমার উপাসনা করেন। তাদের সেই
পুণ্যকর্মের ফলস্বরূপ তারা স্বর্গে যান এবং স্বর্গীয় আনন্দ পান। (9.20) তারা পার্থিব
জগতে ফেরত আসেন বহুবিধ স্বর্গীয় আনন্দ উপভোগের পরে --- তাদের শুভ কর্মফল শেষ হলে। এতদ্বারা বেদের
নির্দেশ পালন করে, কর্মফলের জন্য কর্মরত ব্যক্তিরা বারংবার জন্ম এবং মৃত্যুর মধ্যে
দিয়ে যান। (এছাড়াও
দেখুন 8.25) (9.21) আমি ব্যক্তিগতভাবে
সেই সমস্ত সদা একনিষ্ঠ ভক্তদের আধ্যাত্মিক এবং পার্থিব কল্যান্যের দায়িত্ব নিই
যারা সর্বদা আমায় মনে রাখে এবং একমন হয়ে ধ্যান করে আমাকে তুষ্ট করে। (9.22)
হে অর্জুন, যে সমস্ত ভক্ত বিশ্বাসের সঙ্গে অন্যান্য দেবতার পূজা করে থাকেন,
তারাও আমারই পূজা করছেন কিন্তু অবিধিপূর্বক ভাবে। (9.23) কারণ আমি --- পরমেশ্বর --- একাই সমস্ত যজ্ঞের ভোক্তা এবং সকল জগতের
প্রভু। কিন্তু মনুষ্য আমার প্রকৃত অতীন্দ্রিয় রূপ জানে না। অতএব, তাদের অধঃপতন হয় (জন্ম এবং মৃত্যুর
চক্রে বারংবার পতিত হয়)। (9.24) দেবতাদের ভক্তগন
দেবলোকে যান; পূর্বপুরুষের উপাসকেরা পূর্বপুরুষের কাছে যায়, ভূতের উপাসকেরা
ভূতের কাছে যায়; কিন্তু
আমার উপাসকেরা আমার কাছে আসে (এবং আর জন্মগ্রহণ করেনা)। (এছাড়াও দেখুন 8.16) (9.25) প্রভু ভালোবাসা এবং নিষ্ঠার নৈবেদ্য গ্রহণ করেন যে আমাকে ভক্তির সঙ্গে একটি পাতা, একটি ফুল, একটি
ফল, অথবা জল উৎসর্গ করেন,
আমি বিশুদ্ধে
চিত্তে প্রদান করা সেই নৈবেদ্য গ্রহণ করি। (9.26) হে অর্জুন, তুমি যাই করো, তুমি যাই ভোজন করো, তুমি
হোমের অগ্নিতে যাই উৎসর্গ করো, যাই
কিছু দান করো, অথবা যাই তপস্যা করো, তাঁর সমস্তকিছু আমাতে উৎসর্গ করে করো। (এছাড়াও দেখুন 12.10, 18.46) (9.27) সম্পূর্ণ
ত্যাগের এই মনোভাবের ফলে তুমি কর্মফলের শুভ এবং অশুভের বন্ধন মুক্ত হবে (সন্ন্যাস যোগ)। স্বাধীন
হয়ে তুমি আমার কাছে আসবে। (9.28)
আমি সবার প্রতি সমভাবাপন্ন। আমার প্রিয় এবং অপ্রিয়
কেউ নেই। কিন্তু যারা প্রেম এবং শ্রদ্ধা নিয়ে আমার উপাসনা করেন তারা আমার খুবই
কাছের, এবং
আমিও তাদের খুবই কাছের। এছাড়াও দেখুন (7.18) (9.29) এমনকি যদি সর্বাপেক্ষা পাপিষ্ঠ ব্যক্তিও আমাকে এক
মনে প্রেমপূর্ণ ভক্তি সহকারে স্মরণ করে, তেমন মানুষকে অবশ্যই সাধু আখ্যা দেওয়া হবে কারণ তিনি
সঠিক সমাধান করেছেন। (9.30) এই ধরণের ব্যক্তি
শীঘ্রই ধর্মাত্মায় পরিণত হয় এবং চিরস্থায়ী শান্তি প্রাপ্ত করে। সাবধান থাকো, হে
অর্জুন, যে আমার ভক্তেরা কখনও বিনষ্ট বা পতিত হয় না। (9.31) হে
অর্জুন, স্ত্রীলোক, বৈশ্য, শূদ্র এবং পাপিষ্ঠ সহ যে কেউ প্রেমপূর্ণ ভক্তি সহকারে
আমাকে আশ্রয় করলে তাঁর স্বর্গপ্রাপ্তি হতে পারে। (এছাড়াও দেখুন 18.66) (9.32) পুণ্যাত্মা সাধু
এবং ধর্মীয় রাজ ঋষিদের জন্য পরমাত্মার সন্ধান পাওয়া অনেক সহজ। অতএব, এই আনন্দহীন
এবং ক্ষণস্থায়ী মনুষ্য জীবন প্রাপ্ত করে, সকলের উচিৎ সর্বদাই প্রেমপূর্ণ ভক্তি সহিত আমার পূজা করা। (9.33) মনকে আমাতে কেন্দ্রীভূত করো, আমার প্রতি অনুগত থাকো, আমাকে পূজা করো, এবং আমাকে
প্রণাম করো। এইভাবে নিজেকে আমার সঙ্গে একাত্ম করে, আমাকেই পরম লক্ষ্য স্থির করে,
আমার মধ্যে আশ্রয় নিয়ে, তুমি অবশ্যই আমাকে প্রাপ্ত করবে। (9.34)
10. পরমের বহিঃপ্রকাশ পরমেশ্বর
ভগবান বললেন: হে
অর্জুন, আবার করে আমার মহান বাণী শোনো যা তোমার হিতার্থে আমি তোমাকে বলবো, কারণ
তুমি আমার প্রিয়পাত্র। (10.01)
দেবতারা
এবং মহর্ষিরাও আমার উৎপত্তি সম্বন্ধে
অবগত হতে পারেন না কারণ আমি সকল দেবতা এবং সকল মহর্ষির আদি কারণ। (10.02) মরণশীল
ব্যক্তিদের মধ্যে যিনি আমাকে আদিহীন, জন্মরহিত, এবং সর্বলোকের ঈশ্বর বলে জানেন,
তাকে জ্ঞানী বিবেচনা করা হয় এবং তিনি কর্মফলের বন্ধন থেকে মুক্ত হন। (10.03) বৈষম্য,
আত্ম-জ্ঞান, মোহমুক্তি, ক্ষমা, সততা, মন এবং ইন্দ্রিয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ, প্রশান্তি,
আনন্দ, দুঃখ, জন্ম, মৃত্যু, ভয়, নির্ভয়, অহিংসা, শান্তভাব, সন্তোষ, তপস্যা, দান,
কীর্তি, অপকীর্তি --- মানুষের
মধ্যে এই সমস্ত বিচিত্র গুণ শুধুমাত্র আমার থেকেই আসে। (10.04-05) সপ্ত ঋষি, চার
সনক, চৌদ্দজন মনুষ্য, যার থেকে পৃথিবীর সমস্ত জীবের জন্ম হয়েছিল, তারা আমার শক্তি
থেকেই উৎপন্ন হয়েছিলেন।
(10.06) যিনি প্রকৃতপক্ষে আমার আবির্ভাব এবং যোগশক্তি বোঝেন, তিনি অটল ভক্তিতে আমার সঙ্গে একত্রিত হন। এই ব্যাপারে কোন
সন্দেহ নেই। (10.07) আমি সবকিছুর উৎস। সমস্ত কিছু আমার থেকেই উদ্ভুত হয়। এই তত্ত্ব বুঝে
যিনি তদ্গত হয়ে আমার আরাধনা করেন তিনিই প্রকৃত জ্ঞানী। (10.08)আমার
ভক্তরা চিরকাল সদা সন্তুষ্ট এবং আনন্দিত থাকে। তাদের মন আমার চিন্তায় নিমজ্জিত এবং
তাদের জীবন আমার পায়ে সমর্পিত। তারা একে অপরের সঙ্গে আমার ব্যাপারে আলোচনা করে
আনন্দিত থাকেন। (10.09) ভগবান তাঁর ভক্তদের জ্ঞান প্রদান করেন যারা
সর্বদা প্রেমপূর্ণ ভক্তি সহকারে আমার পূজা করেন এবং যারা চিরকাল আমার সঙ্গে
সংযুক্ত থাকতে চান, তাদেরকে আমি আধ্যাত্ম জ্ঞান প্রদান করি যাতে তারা আমার কাছে
আসতে পারে। (10.10) আমি
তাদের অনুগ্রহ করে তাদের মনের ভিতর চেতনা হিসাবে বসবাস করে অজ্ঞানতার আলো
অতীন্দ্রিয়জ্ঞানের তীব্র রশ্মি দিয়ে বিনষ্ট করি। (10.11) অর্জুন বললেন: আপনি পরম ব্রহ্ম,
পরম ধাম, পরম পবিত্র, শাশ্বত, আদি দেব, অজাত, এবং সর্বত্র বিরাজমান। সমস্ত ঋষিরা
আপনাকে সেইভাবেই বর্ণনা করেছেন। দেবর্ষি নারদ, অসিত, দেবলা, ব্যাস, এবং আপনি নিজেই
আমাকে তাই বললেন। (10.12-13)
বাস্তবের প্রকৃত প্রকৃতি কেউ জানতে পারেনা হে
কৃষ্ণ, আমি বিশ্বাস করি আপনি আমাকে যা বলেছেন তা সত্য। হে প্রভু, না দেবতা, না
দানব কেউই আপনার প্রকৃত প্রকৃতি বুঝতে পারেন না। (এছাড়াও দেখুন 4.06) (10.14) হে সৃষ্টিকর্তা এবং সর্বকিছুর প্রভু,
সর্বদেবতার দেবতা, পরম ব্রহ্ম, এবং
জগতের করতা, আপনি শুধুমাত্র নিজেই নিজেকে জানেন। (10.15) অতএব,
শুধুমাত্র আপনি নিজেই নিজের দিব্যগরিমা এবং আবির্ভাব সম্পূর্ণরূপে বর্ণনা করতে
পারবেন যার মাধ্যমে আপনি সমগ্র জগত জুড়ে রয়েছেন। (10.16) কিভাবে আপনার ধ্যান করলে আপনাকে জানতে
পারবো? হে প্রভু
কোন রূপে বা অবতারে আমি আপনার কথা চিন্তা করবো? (10.17) হে প্রভু, আমাকে আবার বিস্তারিতভাবে আপনার
যোগক্ষমতা এবং গরিমা বোঝান কারণ আপনার অমৃত-ন্যায় কথাগুলি শুনেও আমার পরিতৃপ্তি
হচ্ছে না। (10.18) পরমেশ্বর
ভগবান বললেন: হে
অর্জুন, এবার আমি
তোমাকে আমার প্রধান কয়েকটি রূপের কথা বর্ণনা করবো, কারণ আমার রূপ অসীম। (10.19) হে অর্জুন, আমি
সমস্ত জীবের অন্তঃস্থিত আত্মা। আমি সকল জীবের আদি, মধ্য, এবং অন্ত। (10.20) আমি পালনকর্তা,
জ্যোতিষ্কদের মধ্যে আমি সূর্য, আমি মারুতদের মধ্যে মরীচি, আমি নক্ষত্রের মধ্যে
চন্দ্র। (10.21) আমি বেদ,
আমি দেবতা, আমি ইন্দ্রিয়ের মধ্যে মন, আমি জীবের মধ্যে চেতনা। (10.22) আমি শিব, আমি
সম্পদের দেবতা, আমি অগ্নি এবং পর্বতের দেবতা। (10.23) হে অর্জুন, আমি পুরোহিত এবং দেবতাদের
সেনাপতি। জলাশয়ের মধ্যে আমি সাগর। (10.24) ঋষিদের মধ্যে আমি ঋষি ভৃগু; শব্দের মধ্যে আমি
প্রণব; আধ্যাত্মিক অভ্যাসের মধ্যে আমি নিঃশব্দে মন্ত্র জপ; এবং পর্বতের মধ্যে আমি
হিমালয়। (10.25) দৈব আবির্ভাবের একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা বৃক্ষের
মধ্যে আমি অশ্বত্থ, দেবর্ষিদের মধ্যে আমি নারদ, এবং আমি সমস্ত অন্যান্য দেবতাগন। (10.26) আমাকে জীবের মধ্যে স্বর্গীয় জীব হিসাবে জানো এবং মানুষের মধ্যে রাজা হিসাবে
জানো। আমি অস্ত্রের মধ্যে বজ্র, আমি প্রজনন শক্তিমধ্যে কামদেব। (10.27-28) আমি জলের দেবতা
বরুন এবং আমি পিতৃপুরুষ। আমি মৃত্যুর নিয়ন্ত্রক। আমি নিজের মহান ভক্ত প্রহ্লাদ।
নিরাময়কারীদের মধ্যে আমি মৃত্যু, পশুদের মধ্যে আমি সিংহ, পাখিদের মধ্যে আমি গরুড়। (10.29-30) পবিত্রকারী
বস্তুদের মধ্যে আমি বায়ু এবং যোদ্ধাদের মধ্যে আমি ভগবান রাম। মৎস্যের মধ্যে আমি মকর এবং নদীর মধ্যে আমি পবিত্র গঙ্গা।
(10.31) হে অর্জুন, সমস্ত সৃষ্টির আমি আদি, মধ্য, এবং অন্ত। জ্ঞানের
মধ্যে আমি পরম ব্রহ্মের জ্ঞান। আমি যুক্তিবাদীর যুক্তি। (10.32) অক্ষরমালার মধ্যে
আমি অক্ষর ‘অ’। সমাসের মধ্যে আমি দ্বন্দ্ব সমাস। আমি অবিরাম সময়। আমি সমস্ত জীবের
পালনকর্তা এবং আমার সর্ব দিকেই মুখ রয়েছে (আমি সর্বজ্ঞ)। (10.33) আমি সর্বগ্রাসী
মৃত্যু এবং ভবিষ্যতের জীবের উৎস। সাতটি
গুণাবলীর অধিষ্ঠাত্রী আমি সপ্ত দেবী --- কীর্তি, শ্রী, বাণী, স্মৃতি, মেধা, ধৃতি, ক্ষমা। (10.34) বেদগানগুলির
মধ্যে আমি বৃহৎ সাম। বেদের
মন্ত্রের মধ্যে আমি গায়ত্রী মন্ত্র। মাসের মধ্যে আমি অগ্রহায়ণ, ঋতুর মধ্যে আমি বসন্ত।
(10.35) আমি বঞ্চনাকারীদের মধ্যে জুয়া, তেজস্বীদের মধ্যে আমি
তেজ, বিজয়ীর জিত, সংকল্পের সমাধান, এবং মঙ্গলভাবের মঙ্গল। (10.36)
আমি বৃষ্ণি পরিবারের মধ্যে কৃষ্ণ, পান্ডবের মধ্যে অর্জুন,
মুনিদের মধ্যে আমি ব্যাস, এবং কবিদের মধ্যে উশান। (10.37) আমি শাসকের ক্ষমতা, বিজেতার
রাষ্ট্রনায়কত্ব, গোপনীয়তার মৌনতা, এবং জ্ঞানীর আত্ম-জ্ঞান। (10.38) হে অর্জুন, আমি
সকল প্রাণীর উৎস। কোনকিছু
স্থাবর অথবা জঙ্গম আমাকে ছাড়া অস্তিত্বে থাকতে পারে না। (এছাড়াও দেখুন 7.10 এবং 9.18) (10.39) অবতার সৃষ্টি পরমেশ্বরের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র হে
অর্জুন, এটি আমার স্বর্গীয় বহিঃপ্রকাশের কোন অন্ত নেই। এটি শুধুমাত্র আমার
স্বর্গীয় বহিঃপ্রকাশের ক্ষুদ্র অংশের বর্ণনা। (10.40) যা কিছু গৌরব, উজ্জ্বলতা, এবং শক্তি
সম্পন্ন বলে জানবে --- সেটিকে
আমার একটি ক্ষুদ্র অংশের বহিঃপ্রকাশ বলে জানবে। (10.41) হে অর্জুন, এই বিস্তারিত জ্ঞানের প্রয়োজন
কি? আমি
ক্রমাগত সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডকে আমার স্বর্গীয় ক্ষমতার একটি ক্ষুদ্র অংশ (যোগমায়া)
দিয়ে ধরে রেখেছি। (10.42)
11. বিশ্বরূপ দর্শন অর্জুন
বললেন: আমার
প্রতি অনুগ্রহ করে আপনি যে অধ্যাত্ম তত্ত্ব সম্বন্ধীয় পরম গুহ্য উপদেশ আমাকে
দিয়েছেন, তাতে আমার মোহ দূর হয়েছে। (11.01) হে কৃষ্ণ, আমি আপনার থেকেই সর্বজীবের উৎপত্তি ও লয়, এবং আপনার অব্যয় মাহাত্ম্য সম্বন্ধে জেনেছি।
(11.02) ঈশ্বরের দর্শন পাওয়া ভক্তের জন্য পরম লক্ষ্য হে প্রভু, আপনার আত্ম-তত্ত্ব যথার্থ। কিন্তু তা সত্ত্বেও, হে
পরমেশ্বর আমি আপনার স্বর্গীয় বিশ্বরূপ দর্শন করতে চাই। (11.03)
হে প্রভু, যদি আপনি মনে করেন আমার পক্ষে আপনার
বিশ্বরূপ দর্শন করা সম্ভব, হে যোগেশ্বর, তাহলে তোমার অতীন্দ্রিয় রূপ দেখতে পাবো। (11.04) পরমেশ্বর ভগবান
বললেন: হে
অর্জুন, নানা বর্ণ ও নানা আকৃতিবিশিষ্ট শত শত এবং সহস্র সহস্র আমার বিভিন্ন দিব্য
মূর্তি দর্শন করো। সমস্ত দেবতা এবং অদৃষ্টপূর্ব দিব্য রূপগুলি দেখ। আমার শরীরে অবয়বরূপে একত্রে অবস্থিত সমগ্র স্থাবর জঙ্গম
বিশ্ব এবং অন্য যা কিছু দেখার ইচ্ছা রাখো, তা দর্শন করো। (11.05-07) কিন্তু তোমার চর্মচক্ষুতে তুমি আমাকে দেখতে পাবেনা; তাই
তোমাকে আমি দিব্যচক্ষু প্রদান করছি যাতে তুমি আমার শক্তি এবং গৌরবের মহিমা দর্শন
করতে পারো। (11.08) প্রভু কৃষ্ণ নিজের বিশ্বরূপ দর্শন করালেন সঞ্জয়
বললেন S: হে রাজন,
এই বলে প্রভু যোগেশ্বর কৃষ্ণ, তাঁর অলৌকিক বিশ্বরূপ দেখালেন। (11.09) অর্জুন দেখলেন এই
বিশ্বরূপ বহু মুখ এবং চোখ যুক্ত, অনেক অদ্ভুত আকৃতি এবং অসংখ্য দিব্য অলংকার বিশিষ্ট, বহু
দিব্য অস্ত্রে সজ্জিত, দিব্য মালা এবং দিব্য বস্ত্রে ভূষিত, দিব্য সুগন্ধে
অনুলিপ্ত, অত্যন্ত আশ্চর্যজনক, --- অনন্ত এবং সর্বতোমুখ বিশিষ্ট। (11.10-11) যদি আকাশে সহস্র
সূর্যের প্রভা যুগপৎ উদিত হতো,
তাহলেও সেই দীপ্তি এই বিশ্বরূপ প্রভার সমান হতে পারতো না। (11.12) অর্জুন দেবতাদের
দেবতা প্রভু কৃষ্ণের অতীন্দ্রিয় শরীরে সমগ্র ব্রহ্মান্ডকে বহুভাবে বিভক্ত হয়েও
একত্রে অবস্থিত হতে দেখলেন। (এছাড়াও দেখুন 13.16, এবং 18.20) (11.13) মানুষ ভগবানকে দেখতে প্রস্তুত এবং যোগ্যতাসম্পন্ন নয় (ভগবানের বিশ্বরূপ
দর্শনের পরে) অর্জুন
আশ্চর্য এবং রোমাঞ্চিত হলেন; অবনত মস্তকে, হাত জোড় করে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলেন। (11.14) অর্জুন বললেন: হে প্রভু, আমি আপনার বিশ্বরূপে দেবতা, সমস্ত জগত চরাচর, ঋষি, সর্প
সমূহ, প্রভু শিব, এবং কমলাসনা প্রভু ব্রহ্মাকে দেখতে পাচ্ছি। (11.15) হে জগদীশ্বর সর্বত্র বহু বাহু, বহু উদর, বহু মুখ ও বহু
নেত্রবিশিষ্ট আপনার বিশ্বরূপ আমি দেখছি। হে ভগবান, আমি আপনার আদি, মধ্য, এবং অন্ত দেখছি না। (11.16)
কিরীট, গদা, চক্রধারী এবং সর্বত্র দীপ্তিমান, দুর্নিরীক্ষ্য, প্রদীপ্ত অগ্নি
এবং সূর্যের ন্যায় প্রভাবিশিষ্ট আপনাকে আমি দেখছি। (11.17) আমি বিশ্বাস করি আপনিই ব্রহ্ম এবং একমাত্র জ্ঞাতব্য। আপনি
বিশ্বের পরম আশ্রয়। আপনি পরমেশ্বর এবং সনাতন ধর্মের রক্ষক। (11.18) আমি দেখি আপনি
অনন্ত শক্তিশালী, আদি, মধ্য, এবং অন্তহীন; বহু বাহু যুক্ত; সূর্য এবং চন্দ্র
আপনার চখুদ্বয়; আপনার
মুখ জ্বলন্ত অগ্নির ন্যায় এবং আপনি স্বীয় দীপ্তিতে সমগ্র জগত পরিব্যাপ্ত করেছেন। (11.19) হে প্রভু, স্বর্গ এবং মর্ত্যের মধ্যবর্তী সমস্ত স্থানে সমস্ত দিকে
আপনি ব্যাপৃত। আপনার এই অদ্ভুত এবং ভয়ঙ্কর বিশ্বরূপ দর্শন করে ত্রিভুবন কম্পিত
হচ্ছে। (11.20) সমস্ত
দেবতাগন আপনাতেই প্রবেশ করেছেন। কেউ কেউ ভীত হয়ে করজোড়ে আপনার গুণগান করছেন। বহু
বহু সিদ্ধাত্মা প্রচুর স্তুতি বাক্যের দ্বারা আপনার স্তব করছেন। (11.21) সমস্ত দেব, দেবী,
আদিত্য, রুদ্র, সবাই অবাক হয়ে আপনার দিয়ে তাকিয়ে থাকেন। আপনার বহু মুখ, চক্ষু,
বাহু, উরু, চরণ, উদর এবং দন্ত সহ আপনার অনন্ত রূপ দর্শন করে; সমগ্র জগত ভয়ে
কম্পিত, এবং আমিও অত্যন্ত ভীত হচ্ছি ভগবান। (11.22-23) অর্জুন বিশ্বরূপ দর্শনে ভীত হলেন হে
কৃষ্ণ, আপনার আকাশস্পর্শী, তেজোময়, নানা বর্ণযুক্ত রূপ দর্শন করে; আপনার মুখমন্ডল এবং উজ্জ্বল বিশাল চক্ষু দর্শন করে; আমি ভীত এবং শান্তি ও সাহস
কোনটিই পাচ্ছি না। (11.24) করাল
দন্ত বিশিষ্ট আপনার মুখমন্ডল, প্রলয়াগ্নির ন্যায় যা প্রদীপ্ত তা দর্শন করে, আমি দিকাদিক
জ্ঞান শুন্য হয়েছি এবং কোন শান্তি খুঁজে পাচ্ছি না। আমার উপর দয়া করুন, হে ভগবান,
জগতের আশ্রয়! (11.25) আমার
সমস্ত জ্ঞাতি ভাই, অন্য পক্ষের অন্যান্য বিভিন্ন রাজা এবং যোদ্ধা, আমাদের তরফের
সেনাপতিগন সহ, দ্রুত আপনার করাল দন্ত বিশিষ্ট মুখে প্রবেশ করছে। কিছু মানুষের মাথা
আপনার দাঁতের মধ্যে থেঁতলে যাচ্ছে। (11.26-27) যেমন নদীর জল সমুদ্রে মেশে তেমনই এই সমস্ত
মরণশীল যোদ্ধারা আপনার জ্বলন্ত মুখের মধ্যে প্রবেশ করছে। (11.28) পতঙ্গরা যেমন
ধ্বংস হওয়ার জন্য দ্রুতগতিতে অগ্নির মধ্যে প্রবেশ করে এই সমস্ত মানুষেরাও মৃত্যুর
জন্য দ্রুত আপনার মুখের মধ্যে প্রবেশ করছে। (11.29) আপনি সমস্ত জগতকে
আপনার জ্বলন্ত মুখের মধ্যে প্রবেশ করাচ্ছেন, সমস্ত দিক থেকে গ্রাস করছেন। আপনার
তেজ সমস্ত জগতকে আবৃত করে ফেলেছে এবং প্রজ্জ্বলিত করছে, হে কৃষ্ণ। (11.30) দয়া করে আমাকে
বলুন উগ্রমূর্তি আপনি কি? আপনাকে প্রণাম জানাই, প্রসন্ন হন! আমি আপনাকে বুঝতে চাই,
হে আদিদেব, কারণ আমি আপনার প্রবৃত্তি জানিনা। (11.31) আমরা শুধুমাত্র স্বর্গীয় যন্ত্র পরমেশ্বর
ঈশ্বর বললেন: আমি
মৃত্যু, আমি জগতের ধ্বংস। আমি এই সমস্ত মানুষকে সঙ্ঘার করতে এখানে এসেছি। এমনকি
যুদ্ধে তোমার অংশগ্রহণ ছাড়াও, অপর পক্ষে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সমস্ত যোদ্ধা ধ্বংস
হবে। (11.32) অতএব,
ওঠো এবং কীর্তি লাভ করো। শত্রুকে পরাভূত করো, এবং সমৃদ্ধিশালী রাজ্য উপভোগ করো। এই
সমস্ত যোদ্ধাদের আমি ইতিমধ্যেই ধ্বংস করেছি। তুমি শুধুমাত্র আমার হাতে যন্ত্র, হে অর্জুন। (11.33) এই সমস্ত মহান
যোদ্ধারা যারা ইতিমধ্যেই আমার হাতে ধ্বংস হয়েছেন, তাদের হত্যা করো। ভয় পেয়ো না।
তুমি অবশ্যই যুদ্ধে শত্রুকে পরাস্ত করবে; অতএব, যুদ্ধ করো! (11.34) বিশ্বরূপের কাছে অর্জুনের প্রার্থনা সঞ্জয়
বললেন: কৃষ্ণের
এই বাণী শুনে, অত্যন্ত ভীত অর্জুন হাত জোড় করে কম্পিত স্বরে ভগবান কৃষ্ণকে বললেন। (11.35) অর্জুন বললেন : হে কৃষ্ণ, সকল
সংসার আপনার মহিমা কীর্তন করছে। ভীত দানবেরা চতুর্দিকে পালাচ্ছে। সিদ্ধপুরুষেরা
আপনাকে নমস্কার করছে। (11.36)
হে আদি কারক, ব্রহ্মের চেয়েও মহান, পার্থিব জগতের স্রষ্টা, কেনই বা তারা আপনার
সামনে নতমস্তক হবেনা? হে অনন্ত
প্রভু, হে দেবতাদের দেবতা, সকল জগতের আশ্রয়, আপনি উভয় সৎ (শাশ্বত) এবং অসৎ (ক্ষণস্থায়ী), এবং সেই পরম পুরুষ যিনি সৎ এবং অসতের অতীত। (এছাড়াও দেখুন 9.19, এবং 13.12) (11.37) আপনি আদি দেব, এবং অনাদি পুরুষ। আপনি সকল জগতের পরম আশ্রয়।
আপনি জ্ঞানী, জ্ঞানের বিষয়, এবং পরম জ্ঞাতব্য। আপনি সমস্ত জগত ব্যপ্ত করে আছেন, হে
অনন্ত রূপের অধিকারী প্রভু। (11.38) আপনি মৃত্যু, অগ্নি, বায়ু, বরুন, চন্দ্র, সৃষ্টিকর্তা
ব্রহ্মা, এবং এমনকি ব্রহ্মের পিতারও নিয়ন্ত্রক। আপনাকে বারংবার শত সহস্রবার প্রণাম
জানাই। (11.39) আমি
আপনাকে সম্মুখে নমস্কার করছি, আমি আপনাকে পশ্চাতে নমস্কার করছি। হে প্রভু, আমি সকল
দিক থেকেই আপনাকে নমস্কার করছি। আপনি অন্তত বীরত্ব এবং অসীম বিক্রমশালী। আপনি
সর্বব্যাপী; অতএব, আপনি সর্বত্র এবং সর্বরূপে উপস্থিত। (11.40) আপনাকে শুধুমাত্র বন্ধু হিসাবে জেনে, এবং আপনার মহিমা
সম্বন্ধে অবগত না হয়ে, আমি অসাবধানতাবশত আপনাকে হে কৃষ্ণ, হে যাদব, হে বন্ধু
প্রভৃতি বলে ডেকেছি., শুধুমাত্র
প্রীতি বা অসতর্কতাবশত। (11.41)
ক্রীড়া, শয়ন, বিচরণ, ভোজন করাকালীন যদি কোনভাবে আমি আপনাকে অসম্মান করে থাকি; একা অথবা কারও
সামনে, হে কৃষ্ণ, হে অপরিমেয়, আমি আপনার ক্ষমাপ্রার্থী। (11.42) আপনি এই সজীব এবং
জড় জগতের পিতা, আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ প্রনম্য গুরু। ত্রিভুবনে কেউ আপনার সমান নয়; আপনার থেকে মহান
কেউ কি করে হতে পারে, হে
অতুলনীয় গৌরবের অধিকারী?
(11.43) অতএব, হে পরমপুজ্য ভগবান, আমি নতমস্তকে এবং সাষ্টাঙ্গে
প্রণাম করে আপনার করুণা কৃপা করি। হে প্রভু, পিতা যেমন পুত্রের, সখা যেমন সখার,
এবং স্বামী যেমন স্ত্রীর অপরাধ ক্ষমা করেন, আপনিও সেইভাবে আমার অপরাধ ক্ষমা করুন। (11.44) যা পূর্বে কখনই
দেখা যায়নি তা দর্শন করে আমি আনন্দিত, এবং তা সত্ত্বেও আমার মন ভয়ে ভীত। অতএব, হে
সমস্ত দেবতাদের দেবতা, জগতের আশ্রয়, আমার উপর দয়া করুন এবং আপনার চতুর্ভুজ রূপের
দর্শন দিন। (11.45) আপনি যেকোনো রূপে ভগবানকে দেখতে পারেন আমি
আপনাকে কিরীটী, গদা, চক্রধারীরূপে দেখতে ইচ্ছা করি। অতএব, হে সহস্রবাহু বিশ্বরূপ
প্রভু, দয়া করে আপনার চতুর্ভুজ আকৃতিতে দর্শন দিন। (11.46) পরমেশ্বর বললেন: হে অর্জুন, আমি
তোমার উপর অনুগ্রহ করে নিজ যোগবলে আমার এই নির্দিষ্ট, পরম, প্রজ্জ্বলিত, বিশ্ব,
অসীম, এবং আদি রূপ দেখিয়েছি যা তুমি ছাড়া এর আগে কেউই দেখেনি। (11.47) হে অর্জুন, এই
মনুষ্য জগতে তুমি ছাড়া আর কারও দ্বারা আমার এই রূপ দেখা সম্ভব নয়, এমনকি বেদের
অধ্যয়ন, যজ্ঞ, দান, আচার অনুষ্ঠান, এবং কঠোর তপস্যা দ্বারাও না। (11.48) আমার এই ভয়ঙ্কর রূপ থেকে তুমি বিচলিত এবং বিভ্রান্ত হয়ো না।
ভয় ত্যাগ করে প্রসন্ন মনে আমার এই চতুর্ভুজ রূপ দর্শন করো। (11.49) সঞ্জয় বললেন: অর্জুনের সঙ্গে
এইভাবে কথা বলার পর, কৃষ্ণ তাঁর চতুর্ভুজ রূপের দর্শন দিলেন। এবং তারপর তাঁর সৌম্য
মানবরূপ ধারণ করে, মহান প্রভু কৃষ্ণ, ভীত অর্জুনকে সান্ত্বনা দিলেন। (11.50) অর্জুন বললেন: হে কৃষ্ণ তোমার
এই সৌম্য মানবমূর্তি দেখে আমি শান্ত হলাম এবং আমার স্বাভাবিক লাগছে। (11.51) ভগবানকে ভক্তিপ্রেমের মাধ্যমেই দেখা যায় পরমেশ্বর
ভগবান বললেন: আমার যে
চতুর্ভুজ রূপ তুমি দর্শন করেছ তা দেখা বাস্তবিকই খুবই দুর্লভ। এমনকি দেবতারাও এই
রূপ দেখার আকাঙ্ক্ষা করেন। (11.52) আমার যে চতুর্ভুজ রূপ তুমি দর্শন করলে তা বেদের অধ্যয়ন,
তপস্যা, দান, এমনকি পূজাপাঠ দ্বারাও দর্শন করা সম্ভব হয় না। (11.53)যদিও, শুধুমাত্র একনিষ্ঠ সাধনা দ্বারা, আমাকে এই রূপে দেখা যেতে পারে, আমার স্বরূপ জানা যেতে পারে, এবং আমার কাছে পৌঁছানো যেতে পারে, হে অর্জুন। (11.54) হে অর্জুন, যিনি তাঁর সমস্ত কর্ম আমায় সমর্পণ করেন, যার কাছে আমিই পরম লক্ষ্য, এবং যিনি আমার ভক্ত, যার কোন আসক্তি নেই, এবং যিনি কোন প্রাণীর প্রতি শত্রুভাব রাখেন না – তিনি আমায় প্রাপ্ত করেন। (এছাড়াও দেখুন 8.22) (11.55) 12. ভক্তির পথ ব্যক্তিগত না নৈর্ব্যক্তিক ভগবানের উপাসনা করা উচিৎ অর্জুন বললেন: এদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ যোগী কে ---
যারা একনিষ্ঠ হয়ে (কৃষ্ণ হিসাবে, যা
আপনার ব্যক্তিগত দিক) আপনার উপাসনা করেন নাকি যারা আপনার নৈর্ব্যক্তিক চিরন্তন
সত্তার উপাসনা করেন? (12.01) পরমেশ্বর ভগবান বললেন: আমি সেই সমস্ত যোগীদের শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করি যারা
একনিষ্ঠ হয়ে পরম বিশ্বাসে তাদের ব্যক্তিগত ঈশ্বর হিসাবে আমায় উপাসনা করেন। (এছাড়াও দেখুন 6.47) (12.02) তারা
সমস্ত ইন্দ্রিয় সংযত করে, সমস্ত পরিস্থিতিতে একমন হয়ে, সর্বভূতের কল্যানে রত হয়ে
আমার অপরিবর্তনশীল, অব্যক্ত, অদৃশ্য, সর্বত্র বিরাজময়ান, অচিন্ত্য, অপরিবর্তনীয়,
এবং অচল ধ্রুব সত্তার উপাসনা করেন তারাও আমাকে প্রাপ্ত করেন। (12.03-04) ঈশ্বরের ব্যক্তিগত রূপ উপাসনা করার কারণ আত্ম-উপলব্ধি তাদের জন্য সবচেয়ে কঠিন যারা
নৈর্ব্যক্তিক, অপ্রকাশিত, চিরন্তন সত্তার উপর মনঃসংযোগ করতে চান কারণ দেহধারী
প্রাণীর পক্ষে অপ্রকাশিতের বোধ প্রাপ্ত করা কঠিন। (12.05) কিন্তু
যারা তাদের ব্যক্তিগত ভগবান হিসাবে অটল ভক্তির সঙ্গে আমার উপাসনা করেন, তাদের সমস্ত কর্ম
আমাকে সমর্পণ করেন, আমাকে পরম বলে বিশ্বাস করেন, এবং আমার উপর তাদের ধ্যান ন্যস্ত
করেন; আমি
মৃত্যু পুনর্জন্মের এই মহাসাগরে দ্রুত তাদের ত্রানকর্তা হয়ে উঠি --- হে অর্জুন। (12.06-07) অতএব, তোমার মন আমার উপর কেন্দ্রীভূত করো, এবং তোমার
বুদ্ধিকে শুধুমাত্র আমার ব্যাপারেই চিন্তা করতে দাও (ধ্যান এবং মননের সাহায্যে)।
এইভাবে, তুমি অবশ্যই আমাকে প্রাপ্ত করবে। (12.08) হে
অর্জুন, যদি তুমি তোমার মন অটলভাবে আমার উপর কেন্দ্রীভূত করো, তারপর তোমার
পছন্দমতো যে কোন (অন্য) আধ্যাত্মিক অভ্যাস দ্বারা আমাকে প্রাপ্ত করার জন্য চেষ্টা
করো। (12.09) যদি তুমি
এই জাতীয় আধ্যাত্মিক অভ্যাস করতে অপারগ হও, তাহলে আমার প্রতি তোমার দায়িত্ব পালন করার জন্য
অভিপ্রায় রাখো (নিমিত্ত
হিসাবে, শুধুমাত্র আমার সেবা এবং আমাকে খুশী করার জন্য, কোন স্বার্থপর উদ্দেশ্য
ছাড়া)। (এছাড়াও
দেখুন 9.27, 18.46)
(12.10) যদি তুমি আমার জন্য কাজ করতে অক্ষম হও, তাহলে আমার ইচ্ছেতে
সমর্পণ করো এবং অবনত চিত্তে ( সমস্ত ফলাফলকে, শান্তভাবে ভগবানের ইচ্ছা হিসাবে
গ্রহণ করে নিয়ে) তোমার কর্মের সমস্ত ফল পরিত্যাগ করো। (12.11) শাস্ত্রের জ্ঞান শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের
থেকে শ্রেয়; ধ্যান
শাস্ত্রীয় জ্ঞানের থেকে শ্রেয়; ত্যাগ, অথবা কর্মের ফলের প্রতি স্বার্থপর আসক্তি পরিত্যাগ
করা ধ্যানের থেকে শ্রেয়; শান্তি অবিলম্বে ত্যাগের অনুসরণ করে। (ত্যাগের ব্যাপারে আরও জানুন 18.02,
18.09 তে)
(12.12) যিনি কোন
প্রাণীকে ঘৃণা করেন না, যিনি বন্ধুত্বপূর্ণ এবং দয়াশীল, “আমি” এবং “আমার” বোধ থেকে
যিনি মুক্ত, দুঃখ এবং
আনন্দে যিনি অচঞ্চলচিত্ত,
ক্ষমাশীল; এবং সেই
যোগী যিনি সদা সন্তুষ্ট, যিনি মনকে দমন করছেন, যার সংকল্প দৃঢ়, যার মন এবং
বুদ্ধি সর্বদা আমার ব্যাপারে নিযুক্ত, যিনি আমার প্রতি নিবেদিত – তিনি আমার প্রিয়।
(12.13-14) যিনি
অন্যের মনে বিরক্তি উৎপাদন করেন
না, এবং যিনি অন্যের উপর বিরক্ত নন, যিনি আনন্দ, ঈর্ষা, ভয়, এবং উদ্বেগ মুক্ত, তিনি
আমার কাছে প্রিয়। (12.15)
যিনি নিষ্কাম, খাঁটি, জ্ঞানী, নিরপেক্ষ, এবং উদ্বেগ থেকে মুক্ত; যিনি সমস্ত কাজের
কর্তৃত্ব পরিত্যাগ করেছেন ---তেমন
ভক্ত আমার কাছে প্রিয়।
(12.16) যিনি আনন্দ পান না
দুঃখও অনুভব করেন না, যিনি পছন্দ অথবা অপছন্দ কোনটিই করেন না, যিনি শুভ অশুভ উভয়
পরিত্যাগ করেছনে, এবং যিনি ভক্তিপূর্ণ ---তিনিই আমার কাছে প্রিয়।(12.17)
যিনি বন্ধু এবং শত্রুর প্রতি একই থাকেন, সম্মান বা অপমানে, উষ্ণতা অথবা শীতলতায়, সুখ এবং দুঃখে; যিনি সমস্ত
আসক্তিমুক্ত; যিনি
তিরস্কার বা প্রশংসায় উদাসীন, স্থির, যা আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট, কোন স্থানের
প্রতি যার আসক্তি নেই (কোন দেশ
বা কোন গৃহ), শান্ত,এবং ভক্তিপূর্ণ ---তেমন ব্যক্তি
আমার কাছে প্রিয়। (12.18-19) মানুষের অকপটভাবে স্বর্গীয় বৈশিষ্ট্যগুলির বিকাশ করা উচিৎ কিন্তু সেইসমস্ত বিশ্বস্ত ভক্ত যারা আমার কাছে খুবই
প্রিয় এবং যারা আমাকে তাদের সর্বোচ্চ লক্ষ্য হিসাবে স্থির করে উপরোক্ত নৈতিক মূল্যবোধের
অমৃত অনুসরণ করে (অথবা শুধুমাত্র আন্তরিকভাবে মেনে চলার চেষ্টা করে)। (12.20) 13. সৃষ্টি এবং স্রষ্টা পরমেশ্বর
ভগবান বললেন: হে
অর্জুন, পার্থিব
শরীর, যা ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ড, তাকে ক্ষেত্র বা সৃষ্টি বলা হয়। সত্যদ্রষ্টারা তাকে
স্রষ্টা বলেন যিনি এই সৃষ্টিকে জানেন। (13.01) হে
অর্জুন, আমাকে সকল সৃষ্টির স্রষ্টা হিসাবে জানুন। আমি সৃষ্টি এবং স্রষ্টার প্রকৃত
বোধকে অতীন্দ্রিয় (অথবা আধ্যাত্মিক) জ্ঞান হিসাবে বিবেচনা করি। (13.02) সৃষ্টি কি? এটির
কি প্রকার, এটির রূপগুলি কি কি, এটির উৎস কি, এর স্রষ্টা কে এবং তাঁর ক্ষমতা কি --- আমার থেকে এই সমস্তই সংক্ষেপে শোনো। (13.03) এই সমস্ত
সত্যদ্রষ্টারা সৃষ্টি এবং স্রষ্টাকে বিভিন্ন ভাবে বেদগানের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন,
এবং এছাড়াও ব্রহ্ম-সূত্রের চূড়ান্ত এবং বিশ্বাসযোগ্য শ্লোকগুলিতে বর্ণনা করা
হয়েছে। (13.04) প্রাথমিক
জড় প্রকৃতি, মহাজাগতিক বুদ্ধি, "আমি"
সচেতনতা বা অহং, পাঁচটি প্রাথমিক উপাদান, দশটি অঙ্গ, মন, পাঁচটি ইন্দ্রিয়, এবং
কাম, ঘৃণা, আনন্দ, দুঃখ, শরীর, সচেতনতা, এবং ধৃতি --- এইভাবে সমগ্র ক্ষেত্র সংক্ষেপে বর্ণনা করা
যায় এটির সমস্ত রূপ সহ। (এছাড়াও
দেখুন 7.04) (13.05-06) নির্বাণের পথ হিসাবে রাখা চারটি মহান সত্য বিনয়, দম্ভশুন্যতা, অহিংসা, ক্ষমা, সততা, গুরুসেবা,
পবিত্রতা (চিন্তা, শব্দ,
এবং কর্মের), দৃঢ়তা,
আত্ম-নিয়ন্ত্রণ; ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য
বস্তুর প্রতি বিরাগ, অহংবোধের অভাব; জন্ম, জরা, অসুখ, এবং মৃত্যুতে সহজাত দুঃখ এবং
কষ্টের অবিরত প্রতিফলন; (13.07-08) পরিবারের সদস্য,
বাড়ি প্রভৃতির প্রতি বিচ্ছিন্ন আসক্তি; আকাঙ্খিত এবং অনাকাঙ্খিত উভয়ের প্রাপ্তিতেই শান্তভাব
বজায় রাখা; এবং
একনিষ্ঠ ধ্যানের মাধ্যমে আমার উপর অটল ভক্তি বজায় রাখা, একান্ততা পছন্দ
হওয়া, সামাজিক সমাবেশ এবং কথাবার্তার প্রতি অরূচি; পরমাত্মার জ্ঞান আহরণ করার ক্ষেত্রে দৃঢ়টা, এবং সর্বত্র
বিরাজমান পরম ব্রহ্মকে সর্বত্র দেখতে পাওয়া --- এগুলিকে জ্ঞান বলা হয়। যা এই অজ্ঞানতার একদম বিপরীত। (13.09-11) ভগবানকে শুধুমাত্র দৃষ্টান্ত দিয়ে বর্ণনা করা যায় এবং আর কোন ভাবে নয় এখন আমি
তোমাকে গানের বিষয় সম্বন্ধে বলবো --- যা জেনে তুমি অমরত্ব লাভ করবে। অনাদি পরম ব্রহ্ম না শাশ্বত (সৎ) এবং না ক্ষণস্থায়ী (অসৎ) (এছাড়াও
দেখুন 9.19, 11.37, এবং 15.18) (13.12) শাশ্বত ব্রহ্মের
হাত, পা, চোখ, মাথা, মুখ, এবং কান সর্বত্র কারণ তিনি সর্বব্যাপী এবং সর্বত্র
বিরাজমান। (13.13) তিনি
সমস্ত ইন্দ্রিয় উপলব্ধিকারী যদিও তাঁর নিজের কোন ইন্দ্রিয় নেই; অনাসক্ত এবং তা
সত্ত্বেও সকলের পালনকর্তা;
জড় প্রকৃতির তিন গুণের অতীত, এবং তা সত্ত্বেও জীবসত্ত্বার মাধ্যমে জড় প্রকৃতির
সকল গুণের উপভোগকারী। (13.14)
তিনি সজীব বা নির্জীব সমস্ত বস্তু ভিতরে আছেন। তাঁর সূক্ষ্মতার কারণে তাকে
বোঝা কঠিন। এবং তাঁর সর্বত্র বিরাজমানতার কারণে, উনি সবার খুবই কাছের --- মানুষের মনের
ভিতরে --- তাঁর পরম
ধামে অবস্থান করেন। (13.15)
তিনি অবিভক্ত হয়েও তাকে সর্বভূতে বিভক্ত বোধ হয়। তিনি, জ্ঞানের বিষয়, তিনি রূপ নেন: ব্রহ্মা,
সৃষ্টিকর্তা; বিষ্ণু,
পালনকর্তা; এবং শিব, সকল জীবের
ধ্বংসকর্তা. (এছাড়াও
দেখুন 11.13, এবং 18.20) (13.16) পরম ব্রহ্ম সকল আলোর উৎস। তাকে অন্ধকারের
অতীত হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে (মায়ার অজ্ঞানতা)। তিনি আত্ম-জ্ঞান, তিনি আত্ম-জ্ঞানের বিষয়,
এবং সমস্ত প্রাণী অন্তরে থেকে (অথবা সচেতনতা হিসাবে চেতন মন (18.61 শ্লোক দেখুন)), তাকে আত্ম-জ্ঞান
হিসাবে উপলব্ধি করা হয়। (এছাড়াও
দেখুন 15.06 এবং 15.12) (13.17) এইভাবে সৃষ্টি এবং জ্ঞান এবং জ্ঞানের বিষয় আমি সংক্ষেপে বর্ণনা করেছি। এটি
বুঝে, আমার ভক্ত আমার পরম ধামে আসে। (13.18) পরমাত্মা, আত্মা, জড় প্রকৃতি, এবং জীবাত্মা জড়
প্রকৃতি এবং আধ্যাত্মিক জীব উভয়েই অনাদি। বস্তু এবং মনের সমস্ত বিকার, যাকে গুন
বলা হয়, তা প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন। পার্থিব
শরীর এবং ইন্দ্রিয় ও কর্মের এগারোটি অঙ্গের কারণ প্রকৃতিকে বলা হয়। পুরুষ (সচেতনতা, জীবাত্মা) কে বলা হয় সুখ
এবং দুঃখ অনুভবের কারণ। (13.19-20)
প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পুরুষ জড়
প্রকৃতির তিন গুন উপভোগ করেন। এই গুণগুলির প্রতি আসক্তি (পূর্বের কর্মফলের কারণে ঘটা অজ্ঞানতা হেতু) এর
কারণেই জীবাত্মার সৎ অথবা অসৎ যোনিতে জন্ম হয়। (13.21) পরমাত্মা (ব্রহ্ম, আত্মা,
জীবাত্মা) কে শরীরে
বলা হয় সাক্ষী, নির্দেশক, সহায়ক, উপভোগকারী, পরম প্রভু, এবং এছাড়াও পরম ঈশ্বর। (13.22) তারা যারা
আধ্যাত্মিক জীব (পুরুষ) এবং জড় প্রকৃতি (প্রকৃতি)
কে এটির তিন গুন সহ বোঝে তাদের পুনর্জন্ম হয় না, তারা যেমন ভাবেই জীবন যাপন করুন না কেন। (13.23) ধ্যান, আধ্যাত্মিক
জ্ঞান, অথবা কর্মযোগের দ্বারা পবিত্র
হয়েছেন এমন কিছু মানুষ তাদের অন্তঃমনে থাকা মহান আত্মাকে মন এবং বুদ্ধি দ্বারা
উপলব্ধি করেন। (13.24) শুধুমাত্র বিশ্বাস দ্বারা নির্বাণ প্রাপ্ত করা যায় যদিও,
অন্যান্যরা, ধ্যান যোগ, জ্ঞান, এবং কাজ জানেন না; কিন্তু তারা বিশ্বাসে ভর করে দেবতার পূজা
করে, এমন সাধু
এবং ঋষিরা শাস্ত্রে বলেছেন। তারা যা শুনেছেন তার দৃঢ় বিশ্বাসে মৃত্যুকেও অতিক্রম
করে যান। (13.25) স্থাবর
বা জঙ্গম যা কিছু জন্মায়, হে অর্জুন, যেন তা বস্তু এবং আত্মার মিলনে জন্মায়। (এছাড়াও দেখুন 7.06) (13.26) তিনি যিনি সমস্ত জীবের মধ্যে একই শাশ্বত পরমাত্মা
প্রভুকে বিচরণ করতে দেখেন, তিনি সত্যদ্রষ্টা। (13.27) প্রতি জীবের মধ্যে একই প্রভুর একইভাবে অবস্থানের কারণে,
একজন আরেকজনকে আহত করে না, এবং এইভাবে পরম গতি প্রাপ্ত করেন। (13.28) যখন মানুষ উপলব্ধি করে যে সমস্ত কাজ শুধুমাত্র জড় প্রকৃতির গুনে সম্পন্ন করা
হয়, এবং তাই
নিজেকে এটির কারক বলে বিবেচনা করেন না, তখন মানুষ প্রকৃতই বোঝে। (এছাড়াও দেখুন 3.27, 5.09, এবং 14.19) (13.29) যখনই মানুষ
আবিষ্কার করে বিভিন্ন ধরণের জীব এবং তাদের ধারনাগুলি একই জায়গায় মেশে এবং
শুধুমাত্র সেটি থেকে মুক্তি পাওয়ার ক্ষেত্রেই মানুষ পরমাত্মাকে পায়। (13.30) অনাদি
এবং প্রকৃতির ত্রিগুণে প্রভাবিত না হওয়ার কারণে, শাশ্বত পরমাত্মা --- যদিও জীবের শরীরে
বসবাস করে --- কিছুই
করেনা এবং কোন কিছুতেই লিপ্ত হন না, হে অর্জুন। (13.31) আকাশ যেন সর্বব্যাপী হয়েও কোন কিছুর সঙ্গে
লিপ্ত হয় না কারণ এটি সূক্ষ্ম; একইভাবে আত্মা শরীরের ভিতর থাকলেও তা লিপ্ত হয় না। (13.32) ঠিক যেমন একটিমাত্র সূর্যে জগত আলোকিত হয়; একইভাবে, শাশ্বত সত্তা সমগ্র সৃষ্টিকে আলোকিত (জীবন
দান) করতে থাকে, হে অর্জুন। (13.33) তারাই পরমাত্মাকে
প্রাপ্ত করেন, যারা সৃষ্টি (বা শরীর) এবং স্রষ্টা (বা আত্মা) এর পার্থক্য বোঝেন
আত্ম-জ্ঞানের চক্ষুতে, এবং এবং জীবকে দৈব অলীক শক্তি (মায়া) থেকে মুক্ত করার পন্থা
and know the technique (পাঁচটির মধ্যে যেকোনো একটি পথ অবলম্বন করে
---নিঃস্বার্থ
সেবা, জ্ঞান, ভক্তি, ধ্যান, এবং আত্মসমর্পণ) জানেন। (13.34) 14. প্রকৃতির তিন গুন পরমেশ্বর
ভগবান বললেন: আমি
তোমাকে সকল জ্ঞানের সর্বোত্তম জ্ঞান সম্বন্ধে আরও জানাবো, যা লাভ করে
মুনিঋষিরা এই জীবনের পরে পরম সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। (14.01) যেসমস্ত মানুষ অতীন্দ্রিয় জ্ঞানের মধ্যে
আশ্রয় নেন, তারা আমার সঙ্গে একাত্মতা প্রাপ্ত করেন এবং তারা সৃষ্টির সময় জন্ম
গ্রহণ করেন না বা প্রলয়ের সময় লয় প্রাপ্ত হন না। (14.02) সমস্ত প্রাণী বস্তু এবং আত্মার মিলনে জন্মগ্রহণ করে আমার জড় প্রকৃতি সর্ব সৃষ্টির গর্ভ যেখানে আমি
চেতনের বীজ স্থানপন করি যা থেকে সমস্ত জীব জন্মগ্রহণ করে,
হে অর্জুন। (এছাড়াও দেখুন 9.10) (14.03) বিভিন্ন
গর্ভে যে সমস্ত প্রাণী জন্মগ্রহণ করে, হে অর্জুন, জড় প্রকৃতি তাদের শরীর
প্রদানকারী মাতা; এবং আমি
তাদের জীবন প্রদানকারী পিতা। (14.04) কিভাবে জড় প্রকৃতির তিন গুন শরীরের সঙ্গে আত্মার বন্ধন স্থাপন করে সত্ত্ব বা সদাচরন; রজ বা আসক্তি, কর্ম; এবং তম বা অজ্ঞানতা, নিস্ক্রিয়তা --- জড় প্রকৃতির এই তিন প্রকার (রজ্জু, গুন) রূপ জীবাত্মাকে জীবের মধ্যে আবদ্ধ রাখে, হে অর্জুন। (14.05)
এই তিনটি গুণের মধ্যে সত্ত্ব গুন নির্মল এবং প্রকাশক কারণ এটি শুদ্ধ। হে
নিষ্পাপ অর্জুন, এই গুন সুখ এবং জ্ঞানের আসক্তির দ্বারা আত্মাকে আবদ্ধ করে। (14.06) রজগুন অন্তহীন
কামনা বাসনা থেকে উৎপন্ন হয় এবং
এটি সমস্ত আসক্তি এবং কামের উৎস। এটি জীবাত্মাকে
কাজের ফলাফলের প্রতি আসক্তিতে আবদ্ধ করে। (14.07) হে অর্জুন, জানো, যে তমোগুন জীবের
ভ্রান্তি উৎপাদন করে,
এটি নিস্ক্রিয়তা থেকে জন্মায়। এটি জীবকে প্রমাদ, আলস্য, এবং অত্যধিক নিদ্রায় আবদ্ধ
করে। (14.08) হে
অর্জুন, সত্ত্বগুন জীবকে সুখের বন্ধনে আবদ্ধ করে (পরমাত্মা কে শেখার এবং জানার); রজগুন মানুষকে
সকাম কর্মের প্রতি আসক্ত করে; এবং তমোগুণ আত্ম-জ্ঞানকে ঢেকে দিয়ে প্রমাদের বন্ধনে আবদ্ধ
করে। (14.09) সত্ত্বগুন
যখন প্রবল হয় তখন রজ এবং তমোগুণ পরাজিত হয়; যখন রজগুন প্রবল হয় তখন সত্ত্বগুন এবং
তমোগুন পরাজিত হয়; যখন তমোগুন প্রবল হয় তখন সত্ত্বগুন এবং রজগুন পরাজিত হয়, হে
অর্জুন। (14.10) আত্ম-জ্ঞানের
আলো যখন জড়দেহের ইন্দ্রিয় (অথবা দ্বারগুলিকে) আলোকিত করে, সত্ত্বগুনের প্রকাশ ঘটছে
বলে জানা যায়। (14.11) হে অর্জুন, রজগুন প্রধান হলে, লোভ, কর্মে প্রবৃত্তি,
সকাম কর্মের আধিক্য, অস্থিরতা, উত্তেজনা প্রভৃতি বৃদ্ধি পায়। (14.12) হে অর্জুন, যখন
তমোগুন বৃদ্ধি পায় তখন অজ্ঞানতা, নিস্ক্রিয়তা, প্রমাদ, বিভ্রান্তি প্রভৃতি বৃদ্ধি
পায়। (14.13) এই তিনটি গুণ জীবাত্মার স্থানান্তরে যাওয়ার যান সত্ত্বগুন
প্রবল থাকাকালীন কেউ মারা গেলে তিনি স্বর্গে যান --- পরমাত্মাকে জানেন এমন মানুষদের নির্মল
জগত। (14.14) রজগুন
প্রবল থাকাকালীন কেউ মারা গেলে তিনি কর্মে আসক্ত মানুষের মধ্যে পুনর্জন্ম গ্রহণ
করেন (কার্যকারিতাবাদী)। তমোগুন
প্রবল থাকাকালীন কেউ মারা গেলে তাকে মনুষ্যেতর প্রাণী হিসাবে জন্মগ্রহণ করতে হয়। (14.15) সাত্ত্বিক কর্মের
ফল ভালো এবং পবিত্র হয়; রাজসিক
কর্মের ফল দুঃখ ভোগ হয়; এবং তামসিক কর্মের ফল আলস্য হয়। (14.16) আত্ম-জ্ঞান
সত্ত্বগুন থেকে উদ্ভুত হয়;
রজগুন থেকে লোভ উদ্ভুত হয়; এবং তমোগুণ থেকে অবহেলা, বিভ্রান্তি, এবং মানসিক জড়তা
উদ্বুদ্ধ হয়। (14.17) সত্ত্বগুন সম্পন্ন ব্যক্তিরা স্বর্গে গমন করেন; রজগুন সম্পন্ন
ব্যক্তিরা নরলোকে পুনর্জন্ম গ্রহণ করেন; এবং তমোগুণ সম্পন্ন ব্যক্তিরা নরকে যান (অথবা
মনুষ্যেতর প্রাণী হিসাবে জন্মগ্রহন করেন।). (14.18) জড় প্রকৃতির তিনটি গুন অতিক্রম করার পরে নির্বাণ লাভ করুন জীব যখন
উপলব্ধি করেন যে জড় প্রকৃতির এই তিন গুন ছাড়া কর্মের অন্য কোন কর্তা নেই এবং
পরমেশ্বর ভগবান এই তিন গুণের অতীত, তখন তিনি মুক্তি লাভ করেন। (এছাড়াও দেখুন 3.27, 5.09, এবং 13.29) (14.19) যখন জীব জড় প্রকৃতির এই তিন গুণের অতীত হয় (অথবা অতিক্রম
করে) যা এই শরীর সৃষ্টি করে (এবং/অথবা শরীরে সৃষ্টি হয়), যখন জীব অমরত্ব লাভ করে
এবং জন্ম, জরা ও মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত হয়। (14.20) এই তিন গুণকে অতিক্রম করার পদ্ধতি অর্জুন
বললেন: হে প্রভু
কৃষ্ণ, যারা জড় প্রকৃতির এই তিন গুণ অতিক্রম করে গেছে তাদের লক্ষণ কি এবং তারা কি
ধরণের আচরণ করেন? জীব
কিভাবে জড় প্রকৃতির এই তিন গুন অতিক্রম করেন? (14.21) পরমেশ্বর ভগবান বললেন: প্রকাশ,
প্রবৃত্তি, এবং বিভ্রান্তি উপস্থিত হলে যিনি দ্বেষ করেন না; এবং সেগুলি অনুপস্থিত
হলেও আনন্দিত হন না; যিনি জড়
প্রকৃতির গুনগুলির দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সাক্ষী স্বরূপ থাকতে পারেন; যিনি অটল
হয়ে ভগবানের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে পারেন --- এই চিন্তা করে যে শুধুমাত্র জড় প্রকৃতির গুণাবলীগুলি
কর্ম করে যাচ্ছেন। (14.22-23)
এবং যিনি ভগবানের ভরসায় আছেন তিনি সুখ এবং দুঃখে অবিচল থাকেন; তার কাছে
মৃত্তিকা, প্রস্তর, এবং স্বর্ণ একপ্রকার; যার কাছে প্রিয় এবং অপ্রিয় ব্যক্তি একইরকম; যিনি অবিচল; যিনি তিরস্কার
এবং প্রশংসায় শান্ত থাকেন,
সম্মান এবং অপমানে উদাসীন থাকেন; যিনি বন্ধু এবং শত্রুদের প্রতি নিরপেক্ষ; এবং যিনি কর্মের
অধিকারী হওয়ার ভাব পরিত্যাগ করেছেন। (14.24-25) ভক্তিপ্রেম দ্বারা তিন গুণের বন্ধন মুক্ত করা যায় যিনি প্রেম এবং অটল ভক্তি দ্বারা আমার সেবা করেন
তিনি জড় প্রকৃতির তিন গুনকে অতিক্রম করতে পারেন এবং ব্রহ্মনির্বাণের উপযুক্ত হতে
পারেন (এছাড়াও দেখুন 7.14
এবং 15.19) (14.26) কারণ আমি অমর শাশ্বত আত্মা, চিরস্থায়ী ধর্ম, এবং
পরম সুখের আশ্রয়। (14.27) 15. পুরুষোত্তম সৃষ্টি একটি বৃক্ষ যা মায়ার ক্ষমতায় সৃষ্ট পরমেশ্বর
ভগবান বললেন: তারা
একটি অশ্বত্থ গাছের কথা বলেন যার মূল ঊর্ধ্বে পরমাত্মার মধ্যে রয়েছে এবং তার
শাখাগুলি নিম্নে মহাজগতের মধ্যে রয়েছে, যার পত্রগুলি বেদগান। যিনি এই বৃক্ষটিকে
জানেন তিনি বেদ জানেন। (এছাড়াও
দেখুন 10.08) (15.01) মায়ার
মহাজাগতিক এই বৃক্ষের শাখাগুলি সমগ্র বিশ্বজগৎ জুড়ে রয়েছে। এই বৃক্ষটি জড় প্রকৃতির তিন গুণের দ্বারা
পুষ্ট হয়; ইন্দ্রিয়সুখ
এটির মঞ্জরি; এবং এটির
মূল (অহং এবং
আসক্তি) মনুষ্য
জগতের গভীরে বিস্তৃত হয়, যা
কর্মের বন্ধন সৃষ্টি করে। (15.02)
কিভাবে আসক্তির বৃক্ষচ্ছেদ করা যায় এবং মুক্তি পাওয়া যায় এই
বৃক্ষের প্রকৃত স্বরূপ এই জগতে অবগত হওয়া যায় না, এটির আদি, অন্ত এবং অস্তিত্ব
কোথায় তাও বোঝা যায় না। আত্ম-জ্ঞান এবং অনাসক্তির কুঠার দিয়ে এটির অহং এবং কামের
শক্ত মূলচ্ছেদন করে; এই
চিন্তা করা উচিৎ: "যে পরমেশ্বর
আদিপুরুষ থেকে এই আদি বস্তুর আবির্ভাব হয়েছে আমি তার শরণ নিলাম ", এবং সেই পরম ধাম
প্রাপ্তির চেষ্টা করা উচিৎ যা থেকে
কেউ আবার এই মরণশীল জগতে ফিরে আসেনা। (15.03-04) সেই
জ্ঞানী চিরন্তন লক্ষ্যে পৌঁছান, যিনি অহং এবং মোহ শুন্য, যিনি আসক্তির কুফলকে জয়
করেছেন, যিনি ক্রমাগত পরমেশ্বর ঈশ্বরের চিন্তা করেন এবং যার সমস্ত সকাম ভাবনা
স্তব্ধ, এবং যিনি আনন্দ দুঃখ প্রভৃতি দ্বন্দ্বগুলি থেকে মুক্ত।(15.05)
আমার এই পরম ধাম চন্দ্র, সূর্য, এবং অগ্নি আলোকিত করতে পারে না। সেখানে পৌঁছে
মানুষ চিরকালীন মুক্তি পায় এবং আর কখনই পার্থিব জগতে ফিরে আসে না। (এছাড়াও দেখুন 13.17 এবং 15.12) (15.06) জীবের জড়দেহে আবদ্ধ শাশ্বত আত্মা, আমারই অখণ্ড অংশ।
মন সহ ছটি ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে এটি যুক্ত, এবং বন্ধনে আবদ্ধ। (15.07)
বায়ু যেমন ফুলের গন্ধ অন্যত্র নিয়ে
যায়; একইভাবে,
জড় জগতে জীবাত্মা তার ছয়টি ইন্দ্রিয় মৃত্যুর সময়ে যে শরীর ছেড়ে যায় তার থেকে
পুনর্জন্মের সময়ের নতুন শরীরে নিয়ে (কর্মফলের ক্ষমতায়). (এছাড়াও দেখুন 2.13) (15.08) জীব শ্রবণ,
স্পর্শ, দর্শন, রসন, ঘ্রান, এবং মনন এই ছয়টি ইন্দ্রিয় ব্যবহার করে ইন্দ্রিয় সুখ
অনুভব করে। মূঢ় মানুষ বুঝতে পারে না জীব কিভাবে দেহত্যাগ করে, অথবা কিভাবে জড়
প্রকৃতির গুণের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে ইন্দ্রিয়সুখ অনুভব করে। কিন্তু যাদের
আত্ম-জ্ঞানের চোখ আছে তারা এটি দেখতে পায়। (15.09-10) সিদ্ধিলাভের জন্য যত্নশীল যোগীরা তাদের
অন্তর্মনে (চেতনা হিসাবে) এই জীবাত্মার অবস্থান উপলব্ধি করতে পারেন, কিন্তু মূঢ়
ব্যক্তি যার অন্তর্মন পরিষ্কার নয়, চেষ্টা করেও তাকে উপলব্ধি করেন না। (15.11) সূর্যের
যে জ্যোতি সমগ্র জগতকে উদ্ভাসিত করে তা আমার থেকেই আসে, এবং সেই একই জ্যোতি চন্দ্র
এবং অগ্নির মধ্যেও রয়েছে। (এছাড়াও
দেখুন 13.17 এবং 15.06) (15.12) পৃথিবীতে প্রবেশ
করে, আমি সমস্ত জীবকে আমার শক্তি দিয়ে ধারণ করি। রসাত্মক চন্দ্র হয়ে, আমি সমস্ত
উদ্ভিজ্জের পুষ্টি যোগাই। (15.13)
জঠরাগ্নি হয়ে, আমি সমস্ত জীবের শরীরে বাস করি। জীবনীশক্তি (প্রাণ এবং অপান)
গুলির সঙ্গে একত্রিত হয়ে, আমি সব ধরণের খাদ্য হজম করি। (15.14) আমি সকল প্রাণীর হৃদয়ে অবস্থিত রয়েছি। আমার থেকেই সমস্ত
জীবের স্মৃতি, আত্ম-জ্ঞান আসে এবং সংশয় ও ভুল ধারনা ((সমাধি) ধ্যান বা যুক্তির
মাধ্যমে চিরন্তন সত্তার ব্যাপারে) দূর হয়। আমি সেই সত্য যা সমস্ত বেদ পাঠ করে জানা
যায়। আমিই বেদান্তের রচয়িতা এবং সমস্ত বেদবেত্তা। (এছাড়াও দেখুন 6.39) (15.15) পরমাত্মা, আত্মা এবং সৃষ্ট প্রাণীকুল কি কি? মহাজগতে
দুই প্রকার জীব (পুরুষ) রয়েছে: পরিবর্তনশীল অথবা ক্ষণস্থায়ী স্বর্গীয় জীব (ক্ষর পুরুষ),
এবং অব্যয় চিরন্তন সত্তা (ব্রহ্ম,
অক্ষর পুরুষ)। সমস্ত
সৃষ্ট প্রাণী পরিবর্তনশীল, কিন্তু চিরন্তন ব্রহ্মের কোন পরিবর্তন হয় না। (15.16) পরমেশ্বর
পুরুষোত্তম সত্তা উভয় ক্ষণস্থায়ী স্বর্গীয় জীব এবং চিরন্তন সত্তা উভয়ের অতীত।
তাঁকে পরম বাস্তব বা পরমাত্মা বলা হয়, যিনি সর্বব্যাপী হয়ে উভয় ক্ষণস্থায়ী এবং
চিরস্থায়ী উভয়কে ধারণ করেন। (15.17) Because যেহেতু আমি ক্ষণস্থায়ী এবং চিরন্তন উভয়ের অতীত,
আমি এই পৃথিবীতে এবং বেদে আদিনাথ (পরাব্রহ্ম, পরমাত্মা, পুরুষোত্তম, পরম, সত্য, সৎ, প্রভৃতি) হিসাবে পরিচিত। (15.18) হে
অর্জুন, যিনি আমাকে পুরুষোত্তম হিসাবে জানেন, তিনি সর্বজ্ঞ এবং তিনি সর্বতোভাবে
আমার পূজা করেন। (এছাড়াও
দেখুন 7.14, 14.26, এবং 18.66) (15.19) হে নিষ্পাপ
অর্জুন, এইভাবে আমি তোমার কাছে আত্ম-জ্ঞানের সবচেয়ে গোপন জ্ঞান প্রকাশ করলাম। এই
জ্ঞান অবগত হয়ে মানুষ আলোকিত হয়; তার সমস্ত কর্তব্য সম্পূর্ণ হয়; এবং তার
মনুষ্যজন্মের হেতু পূরণ হয়। (15.20) 16. স্বর্গীয় এবং আসুরিক গুন মুক্তির জন্য যে প্রধান স্বর্গীয় গুণাবলীগুলির চর্চা করা উচিৎ পরমেশ্বর
ভগবান বললেন: হে
অর্জুন, ভয়শুন্যতা, হৃদয়ের পবিত্রতা আত্ম-জ্ঞান যোগের অনুশীলন, দান, আত্মসংযম,
যজ্ঞ অনুষ্ঠান, শাস্ত্র অধ্যয়ন, তপস্যা, সততা; অহিংসা, সত্যবাদিতা, ক্রোধশুন্যতা, বৈরাগ্য, শান্তি,
অন্যকে দোষ না দেওয়া, সমস্ত জীবে দয়া, লোভ থেকে মুক্তি, নম্রতা, বিনয়, অচপলতা, তেজ, ক্ষমা,
ধৈর্য, পরিচ্ছন্নতা, মাৎসর্য শূন্যতা, অভিমান শূন্যতা --- এই (ছাব্বিশটি)
গুনগুলি স্বর্গীয় গুণাবলী সমৃদ্ধ। (16.01-03) আসুরিক প্রবৃত্তির তালিকা যা পরিত্যাগ করা উচিৎ হে
অর্জুন, যারা আসুরিক ভাব নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তাদের গুণাবলীগুলি হল: কাপট্য, দম্ভ,
অভিমান, ক্রোধ, কর্কশ বাক্য, এবং অজ্ঞতা। (16.04) স্বর্গীয় গুণাবলী মুক্তির (মোক্ষের) পথে
নিয়ে যায়; আসুরিক
গুণাবলী বন্ধনের পথে নিয়ে যায়। দুঃখ করোনা, হে অর্জুন; তুমি স্বর্গীয় গুণাবলী নিয়ে
জন্মেছ। (16.05) দুই ধরণের মানুষ আছে: জ্ঞানী এবং অজ্ঞ প্রধানত, এই জগতে দুই ধরণের বা জাতের মানুষ আছে:
স্বর্গীয় এবং আসুরিক। হে
অর্জুন, তোমাকে আমি স্বর্গীয় ভাবসম্পন্ন প্রাণীদের সবিস্তার বর্ণনা দিয়েছে। এখন
আমার কাছ থেকে আসুরিক ভাবসম্পন্ন প্রাণীদের সম্বন্ধে শোন। (16.06) আসুরিক
ভাবসম্পন্ন ব্যক্তি জানেন না কি করবেন এবং কি করবেন না। তাদের পবিত্রতা নেই,
সদাচার নেই, এবং সততা নেই। (16.07) তারা বলেন এই জগত মিথ্যা, ভিত্তিহীন, ঈশ্বরহীন, এবং
ধর্মহীন। কামবশত নারী এবং পুরুষের মিলনে এই জগতের সৃষ্টি হয়েছে এবং আর কিছু না। (16.08) এই প্রকার ভুল
ধর্মহীন সিদ্ধান্ত অবলম্বন করে, এই ক্ষুদ্রবুদ্ধি এবং উগ্রস্বভাব অধঃপতিত
ব্যক্তিরা শত্রু হিসাবে জন্মায় এবং পৃথিবীর ধ্বংস সাধন করে। (16.09) অপূরণীয় কামনা,
কাপট্য, দম্ভ, এবং দর্পে পরিপূর্ণ হয়ে; holding বিভ্রান্তির কারণে ভুল ধারনা বশত; তারা অপবিত্র
উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে,
(16.10) মৃত্যু পর্যন্ত অফুরন্ত উদ্বেগে আচ্চন্ন হয়ে, ইন্দ্রিয় সুখের
তুষ্টিকেই সর্বোচ্চ লক্ষ্য বিবেচনা করে, এবং ইন্দ্রিয়সুখই সর্বকিছু এমন প্রত্যয় নিয়ে; (16.11) শত শত আসক্তির পাশে আবদ্ধ হয়ে এবং কাম ও ক্রোধের বশীভূত হয়ে, তারা অসৎ উপায়ে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করেন যাতে তাদের ইন্দ্রিয়সুখের
পূর্তি করতে পারেন। তারা মনে করেন: (16.12) আমি আজকে এটি অর্জন করেছি; আমার এই ইচ্ছা
পূরণ করা উচিৎ; আমার এই পরিমাণ
সম্পদ রয়েছে এবং ভবিষ্যতে আমার আরও সম্পদ থাকবে; (16.13) এই শত্রুর আমি নাশ করেছি, এবং আমি অন্যান্যদেরও
নাশ করবো। আমি প্রভু। আমি উপভোগকারী। আমি সফল, শক্তিশালী, এবং খুশী; (16.14) আমি ধনী এবং আমি অভিজাত পরিবারে জন্মেছি। আমার সমান কে আছে?? আমি যজ্ঞ করবো,
আমি দান করবো, আমি আনন্দ করবো। (16.15) এইভাবে অজ্ঞানতায় বিভ্রান্ত হয়ে, বহু আসক্তিকে মোহাচ্ছন্ন হয়ে,
বিভ্রমের জালে জড়িয়ে গিয়ে,
ইন্দ্রিয়সুখের উপভোগে আসক্ত হয়ে, তারা অসুচি নরকে পতিত হয়। (16.16) আত্মগর্বী,
অনম্র, দম্ভ এবং সম্পদের নেশায় পরিপূর্ণ, তারা যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন, দান করেন, শুধু নাম মাত্র,
এবং শাস্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী নয়। (16.17) এই আসুরিক ভাবাপন্ন ব্যক্তিরা অহংকার, শক্তি, দম্ভ, কাম এবং
ক্রোধে পরিপূর্ণ থাকেন; এবং
তারপর তারা আমার শরীরে এবং অন্যদের শরীরে আমার উপস্থিতি অস্বীকার করেন। (16.18) এই
বিদ্বেষী, ক্রূর, নরাধমদের আমি বারংবার সংসারে অসুরযোনিতে জন্মগ্রহণ করাই। (16.19) হে অর্জুন,
জন্মের পর জন্ম, অসুরযোনিতে প্রবিষ্ট হয়ে, বিভ্রান্ত জীব নরকে প্রবেশ করে কখনই
আমাকে প্রাপ্ত না করে। (16.20) লালসা, ক্রোধ, এবং লোভ নরকের
তিনটি দরজা কাম, ক্রোধ, এবং লোভ নরকের তিনটি দরজা যা জীবের
অধঃপতনের (অথবা বন্ধনের) কারণ। তাই জীবের অবশ্যই এই তিনটি পরিত্যাগ করা (বা
পরিত্যাগ করতে শেখা) উচিৎ। (16.21) যারা নরকের এই
তিনটি দরজা থেকে মুক্ত, হে অর্জুন, শ্রেষ্ঠ তাই করেন এবং ফলাফলস্বরূপ পরম ধাম
প্রাপ্ত হয়। (16.22) কিন্তু
যে শাস্ত্রীয় নিষেধ না মেনে নিজের আসক্তির প্রভাবে কাজ করে, সে না সিদ্ধি লাভ
করে, না সুখ লাভ করে, এবং না মোক্ষ লাভ করে। (16.23) অতএব,
কি করা উচিৎ এবং কি করা উচিৎ নয় সেই ব্যাপারে শাস্ত্রকে আপনার পথপ্রদর্শক হতে
দিন। শাস্ত্রের বিধিনিষেধ অনুযায়ী আপনার কর্তব্য পালন করা উচিৎ। (16.24)
17. ত্রিগুণ শ্রদ্ধা অর্জুন
বললেন: হে
কৃষ্ণ, যারা শাস্ত্রের বিধান পরিত্যাগ করে শুধুমাত্র শ্রদ্ধাবশত পূজাপাঠ করে,
তাদের ভক্তির গুণ কি? এটি কি
সাত্ত্বিক, রাজসিক, না তামসিক? (17.01) পরমেশ্বর
ভগবান বললেন: দেহীর
স্বাভাবিক শ্রদ্ধা তিন প্রকার: সাত্ত্বিক, রাজসিক, এবং তামসিক। এবার এগুলির সম্বন্ধে আমার
থেকে জানো। (17.02) হে অর্জুন, (কর্মফলের প্রভাবে) প্রত্যেকের শ্রদ্ধা তাদের নিজ
স্বভাব অনুযায়ী হয়। জীব তার শ্রদ্ধার দ্বারাই পরিচিত। জীব চাইলে যে কোন কিছু
হতে পারে (যদি ক্রমাগত
শ্রদ্ধার সঙ্গে কাঙ্খিত বস্তুর ধ্যান করে). (17.03) সাত্ত্বিক
গুণসম্পন্ন ব্যক্তি দেবতাদের সাধনা করেন; রাজসিক গুণসম্পন্ন ব্যক্তি যক্ষ এবং রাক্ষসদের পূজা
করেন; এবং
তামসিক গুণসম্পন্ন ব্যক্তি ভূতপ্রেতের পূজা করেন। (17.04) আসুরিক ভাবাপন্ন মূঢ় ব্যক্তি তারা যারা
শাস্ত্রের বিধান না মেনে কঠোর তপস্যা করেন, যারা কাপট্য এবং দম্ভে পরিপূর্ণ, যারা কাম এবং
আসক্তির বলে তাড়িত, এবং যারা বুদ্ধিহীনভাবে দেহের উপাদানগুলিকে নির্যাতন করে, এবং
সেই সঙ্গে দেহস্থ আমাকেও নির্যাতন করে। (17.05-06) আমাদের
সবার পছন্দের খাদ্য তিন প্রকার। যজ্ঞ, তপস্যা,
এবং দানও তিন প্রকার। এবার তাদের মধ্যে পার্থক্য শোন। (17.07) যে সমস্ত আহার
আয়ু, উদ্যম, বল আরোগ্য, সুখ এবং প্রীতি বৃদ্ধি করে সেগুলি সরস, মসৃণ, সারগর্ভ, এবং
পুষ্টিকর। সাত্ত্বিক গুণসম্পন্ন মানুষের এই খাদ্য পছন্দ হয়। (17.08) রাজসিক ব্যক্তিরা
সেই খাদ্য পছন্দ করেন যা খুবই তিক্ত, অম্ল, লবণাক্ত, উষ্ণ, তীক্ষ্ণ, শুষ্ক, এবং
প্রদাহ; এগুলি দুঃখ, শোক, এবং অসুখ সৃষ্টি করে। (17.09) অজ্ঞান ব্যক্তি সেই খাদ্য পছন্দ করেন যা
বাসি, বিস্বাদ, দুর্গন্ধযুক্ত, বিকৃত, উচ্ছিষ্ট, এবং অশুচি (যেমন মাংস এবং মদ)। (17.10) কোন
ফলাফলের আকাঙ্ক্ষা না করে, এটি কর্তব্য এই দৃঢ় বিশ্বাস এবং প্রত্যয়ে শাস্ত্রীয়
বিধি অনুসারে অনুষ্ঠান করা যজ্ঞ হল সাত্ত্বিক যজ্ঞ। (17.11) ফলাফলের আশা করে
সম্পন্ন করা এবং শুধুমাত্র লোক দেখানোর জন্য পালন করা যজ্ঞ হল রাজসিক যজ্ঞ। (17.12) শাস্ত্রবিধি
বিবর্জিত, যেখানে কোন প্রসাদ বিতরণ করা হয়না, যা মন্ত্র, শ্রদ্ধা, এবং নৈবেদ্যহীন,
তাকে বলা হয় তামসিক যজ্ঞ। (17.13) মানসিক, বাচিক, এবং কায়িক তপস্যা দেবতা,
ব্রাহ্মন, গুরু, এবং জ্ঞানীর পূজা; পবিত্রতা, সততা, ব্রহ্মচর্য, এবং অহিংসা --- এগুলিকে কায়িক
তপস্যা বলা হয়। (17.14) অনাপত্তিকর, সত্য, প্রিয়, হিতকর, এবং শাস্ত্রের নিয়মিত অধ্যয়নের
জন্য যে শব্দ ব্যবহার করা হয় সেগুলিকে বাচিক তপস্যা বলে। (17.15)
মনের নির্মলতা, নম্রতা, শান্তভাব, আত্ম-নিয়ন্ত্রণ, এবং চিন্তার পবিত্রতা --- এগুলিকে মানসিক
তপস্যা বলে। (17.16) উপরোক্ত
তিন ধরণের তপস্যা (মানসিক,
বাচিক, এবং কায়িক), যা
যোগীরা সর্বোচ্চ বিশ্বাসে অভ্যাস করেন, কোন ফলের আশা না কর, তাকে সাত্ত্বিক তপস্যা বলা হয়। (17.17) যে তপস্যা
সম্মান, প্রশংসা এবং পূজা পাওয়ার আশায়, দম্ভ সহকারে করা হয়, যা থেকে অনিশ্চিত এবং
অনিত্য ফল পাওয়া যায়, তাকে বলা হয় রাজসিক তপস্যা। (17.18) যে তপস্যা বোকা একগুঁয়েমি বা নিজেকে কষ্ট
দিয়ে করা হয় অন্য কারও ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে, তাকে বলা হয় তামসিক তপস্যা। (17.19) দানকে
কর্তব্য মনে করে, এবং প্রত্যুপকারের আশা না রেখে, উপযুক্ত স্থানে উপযুক্ত সময়ে
উপযুক্ত পাত্রে যে দান করা হয় তাকে সাত্ত্বিক দান বলে। (17.20) অনিচ্ছাসত্ত্বেও, বিপরীতে কিছু পাওয়ার আশা করে অথবা কোন
লাভের আশায় যে দান করা হয় তাকে রাজসিক দান বলে। (17.21) ভুল
স্থানে এবং সময়ে, অবজ্ঞা সহকারে এবং অনাদরে অপাত্রে যখন দান করা হয় তাকে তামসিক
দান বলে। (17.22) ‘ওম তৎ সৎ’ এটিকে ঈশ্বরের
ত্রিবিধ নাম বলা হয়। শুভ গুণাবলী যুক্ত মানুষ, বেদ, এবং নিষ্কাম কর্ম প্রাচীন সময়ে
ব্রহ্মা সৃষ্টি করেছিলেন। (17.23)
তাই ঈশ্বরের স্বরূপ জানেন যারা তারা যজ্ঞ, দান, অথবা শাস্ত্রে বিহিত তপস্যার
ক্ষেত্রে সবসময় ‘ওম’ বলে শুরু করেন। (17.24) মোক্ষ অভিলাষী ব্যক্তিরা ফলের আশা না করে
বিভিন্ন ধরণের যজ্ঞ, দান এবং তপস্যা করার সময় ‘তৎ’ (বা তিনিই সব) শব্দের উল্লেখ করেন (17.25)। সৎভাব এবং সাধুভাব বোঝানোর জন্য ‘সৎ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়। ‘সৎ’ শব্দটি একটি শুভ কাজের জন্যেও ব্যবহার করা হয়, হে অর্জুন।
(17.26) যজ্ঞ,
দান, এবং তপস্যায় বিশ্বাসকেও ‘সৎ’ শব্দ দ্বারা
বোঝানো হয়। পরমেশ্বরের জন্য নিষ্কাম কর্মকেও, বাস্তবে, ‘সৎ’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়। (17.27) যা
কিছু শ্রদ্ধা ছাড়া করা হয় --- তা যজ্ঞ, দান, অথবা তপস্যা, বা অন্য কোন কাজ হোক ---
তাকে ‘অসৎ’ বলা হয়। ইহজগতে বা তার পরেও এর কোন মূল্য নেই, হে অর্জুন।
(17.28) 18. অহং ত্যাগ করে মোক্ষ প্রাপ্তি করা অর্জুন
বললেন: হে প্রভু
কৃষ্ণ, আমি সন্ন্যাস এবং ত্যাগ শব্দের প্রকৃতি এবং তাদের মধ্যে পার্থক্য জানতে
ইচ্ছা করি। (18.01) পরমেশ্বর ভগবান বললেন: ঋষিরা ব্যক্তিগত লাভের জন্য কর্মের সম্পূর্ণ
পরিত্যাগকে সন্ন্যাস বলেন। সমস্ত কাজের ফলের প্রতি স্বার্থপর আসক্তি পরিত্যাগ করা
এবং এই আসক্তি থেকে মুক্তিকেই জ্ঞানীরা ত্যাগ বলেন। (এছাড়াও দেখুন 5.01, 5.05, এবং 6.01) (18.02) কিছু
দার্শনিক মনে করেন সর্ব কর্মেই দোষ আছে তাই সর্ব কর্ম পরিত্যাগ করা উচিৎ, যেখানে অন্যরা মনে করেন যজ্ঞ, দান, এবং তপস্যার মতো কর্ম
পরিত্যাগ করা উচিৎ নয়। (18.03) হে অর্জুন, ত্যাগের ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্ত শোনো। ত্যাগ তিন প্রকার। (18.04) যজ্ঞ, দান, এবং
তপস্যা কখনই ত্যাগ করা উচিৎ নয়, বরং
এগুলির সম্পাদন করা উচিৎ কারণ যজ্ঞ,
দান এবং তপস্যা এমনকি জ্ঞানীকেও পবিত্র করে। (18.05) এমনকি এই বাধ্যতামূলক কাজগুলিও কাজের
ফলাফলের প্রতি আসক্তি না রেখে করা উচিৎ। হে অর্জুন,
নিশ্চিত পরম পরামর্শ। (18.06)
নিত্যকর্ম
কখনই ত্যাগ করা উচিৎ নয়। মোহবশত
কেউ যদি নিত্যকর্ম ত্যাগ করেন তাহলে তাকে তামসিক ত্যাগ বলা হবে। (18.07) যদি কেউ নিত্যকর্ম
কঠিন বলে অথবা শারীরিক দিক থেকে কষ্টকর এই ভয়ে পরিত্যাগ করেন, তাহলে সেই ত্যাগকে
রাজসিক বলা হয় এবং এই ত্যাগের ফল লাভ হয় না। (18.08) যিনি কর্তব্যবোধে নিত্যকর্ম অনুষ্ঠান করেন
এবং এটির ফলাফল ও আসক্তি পরিত্যাগ করেন, শুধুমাত্র সেটিকেই সাত্ত্বিক ত্যাগ বলা
হয়, হে অর্জুন। (18.09) যিনি
অপ্রীতিকর কাজ অপছন্দ করে না, সুখকর কাজেও যার আসক্তি নেই, তাকেই প্রকৃত ত্যাগী
বলা হয়, তিনি
সাত্ত্বিক গুণসম্পন্ন, বুদ্ধিমান, এবং পরমাত্মার বিষয়ে তার কোন সংশয় নেই। (18.10) মনুষ্য কাজ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে পারেনা। তাই জিনিস
কর্মের সমস্ত ফলের প্রতি স্বার্থপর আসক্তি পরিত্যাগ করেছেন, তাকেই ত্যাগী বিবেচনা
করা হয়। (18.11) কর্মের তিন প্রকার ফল আছে --- ইষ্ট, অনিষ্ট,
এবং মিশ্র --- যা
মানুষকে মৃত্যুর পরে ভোগ করতে হয়, কিন্তু ত্যাগীকে কখনই তা করতে হয় না। (18.12) হে অর্জুন,
আমার থেকে শেখো, সাংখ্য অনুযায়ী পাঁচটি কারণ বর্ণনা করা হয়েছে যেকোনো কর্মের
সিদ্ধির জন্য। এগুলি হল: পার্থিব
শরীর, যা কর্মের আসন; জড়
প্রকৃতির গুণ, কারক; ইন্দ্রিয়
এবং কর্মের এগারোটি অঙ্গ,
যন্ত্র; বিভিন্ন
প্রাণ (জৈব,
জীবনীশক্তি); এবং
পঞ্চমটি অধিষ্ঠাতা দেবতা (এগারোটি
অঙ্গের)। (18.13-14) শরীর, বাক্য, এবং
চিন্তা দ্বারা মানুষ যে কার্য করে, তা সঠিক হোক বা ভুল, এগুলি তার পাঁচটি কারণ। (18.15) অতএব, হে মূঢ়
ব্যক্তি এই পঞ্চকারণের কথা বিবেচনা না করে শুধুমাত্র নিজের শরীর বা আত্মাকেই কর্তা
বলে মনে করে, তিনি অসম্পূর্ণ জ্ঞানের কারণে বোঝেন না। (18.16) আমি কর্তা এই
অভিমান যার নেই এবং যার বুদ্ধি কর্মফলের আসক্তিদ্বারা কলুষিত নয় --- এমনকি সমস্ত
প্রাণী হত্যা করলেও --- তিনি
হত্যাকারী নন এবং হত্যা ক্রিয়ার দ্বারা আবদ্ধ হন না। (18.17) বিষয়, বস্তু, এবং
বস্তুর সম্বন্ধে জ্ঞান, এই তিনটি কর্মের ত্রিবিধ চালিকা শক্তি (বা প্রেরণা)।
ইন্দ্রিয় এবং কর্মের এগারোটি অঙ্গ, কর্ম, এবং জড় প্রকৃতির তিনটি গুণ কর্মের তিনটি
উপাদান। (18.18) আত্ম-জ্ঞান,
কর্ম, এবং কর্তা তিন ধরণের, সাংখ্য মতে গুণ তত্ত্ব অনুযায়ী। যথাযথভাবে এগুলি
সম্মন্ধেও শোনো। (18.19) যে জ্ঞান
দ্বারা সমস্ত প্রাণিতে একই চিন্ময় ভাব দৃশ্যমান হয়, অনেক জীব পরস্পর ভিন্ন হলেও
চিন্ময় সত্ত্বায় তারা এক, এই জ্ঞানকে সাত্ত্বিক জ্ঞান বলা হয়। (এছাড়াও দেখুন 11.13, এবং 13.16) (18.20) যে জ্ঞানের
মাধ্যমে বিভিন্ন প্রাণীতে ভিন্ন আত্মা আছে বলে মনে হয়; সেই জ্ঞানকে রাজসিক জ্ঞান
বলা হয়। (18.21) যে
অযৌক্তিক, ভিত্তিহীন, এবং মুল্যহীন জ্ঞানের দ্বারা মানুষ শুধুমাত্র একটি প্রভাব
(যেমন শরীর) এর উপর মনোযোগ দেয় যেন এটিই সবকিছু, তেমন জ্ঞানকে তামসিক জ্ঞান বলা
হয়। (18.22) ফলের
আকাঙ্ক্ষা না করে, রাগ বা দ্বেষ বর্জনপূর্বক আসক্তিশুন্য হয়ে যে নিত্যকর্ম
অনুষ্ঠান করা হয়, তাকে সাত্ত্বিক কাজ বলে। (18.23) অহং ভাব সহ, ফলের আকাঙ্ক্ষা করে, বহু
কষ্টে আসক্তিযুক্ত হয়ে যে কাজ সম্পূর্ণ কর হয় তাকে রাজসিক কাজ বলে। (18.24) বিভ্রান্তির
কারণে যে কাজ করা হয়, যে কাজ করার জন্য পরিণতি, ক্ষতি, অন্যদের আঘাত এবং কারও নিজ
ক্ষমতার বিবেচনা না করে যে কাজ করা হয় তাকে তামসিক কাজ বলা হয়। (18.25) যে কর্তা
আসক্তিমুক্ত, অহং-মুক্ত, ধৃতি এবং উৎসাহসমন্বিত,
সাফল্য এবং ব্যর্থতায় অবিচলিত, তাকে সাত্ত্বিক কর্তা বলা হয়। (18.26) যে কর্তা
বিষয়াসক্ত, কর্মফল লুব্ধ, যিনি লোভী, সহিংস, অপবিত্র, এবং জিনিস সুখ ও দুঃখ দ্বারা
প্রভাবিত, তাকে বলা হয় রাজসিক কর্তা। (18.27) যে কর্তা উচ্ছৃঙ্খল, অশ্লীল, একগুঁয়ে,
দুষ্ট, অন্যের বদনামে রত, অলস, হতাশ, এবং গড়িমসি করে, তাকে বলে তামসিক কর্তা। (18.28) হে অর্জুন, এবার আমি সম্পূর্ণভাবে এবং আলাদাভাবে ব্যাখ্যা
করি তুমি শোনো, জড় প্রকৃতির গুণের উপর ভিত্তি করে বুদ্ধি এবং ধৃতির ত্রিবিধ
বিভাগ। (18.29) হে
অর্জুন, যে বুদ্ধির দ্বারা প্রবৃত্তি, নিবৃত্তি, কার্য ও অকার্য, ভয় ও অভয়, বন্ধন
এবং মুক্তির পার্থক্য নিশ্চিত বোঝা যায় তাকে বলা হয় সাত্ত্বিকি বুদ্ধি। (18.30) যে বুদ্ধির
দ্বারা ধর্ম ও অধর্ম, কার্য ও অকার্য এর মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করা যায়না তাকে
বলা হয় রাজসিক বুদ্ধি, হে অর্জুন। (18.31) হে অর্জুন, হে বুদ্ধি অজ্ঞান এবং
মোহাচ্ছন্ন হয়ে অধর্মকে ধর্ম বলে মনে করে এবং ধর্মকে অধর্ম বলে মএন করে এবং সবকিছু
বিপরীতভাবে বোঝে, তাকে তামসিক বুদ্ধি বলা হয়। (18.32) তিন ধরণের ধৃতি এবং চার ধরণের মনুষ্য জীবনের লক্ষ্য হে অর্জুন,
হে ধৃতি মন, প্রাণ (জৈবআবেগ, জীবনী শক্তি) এবং ইন্দ্রিয়গুলির কাজকে শুধুমাত্র ঈশ্বরের উপলব্ধির
জন্য নিপুণভাবে ব্যবহার করেন, যে ধৃতিকে বলা হয় সাত্ত্বিক। (18.33) ফলের আকাঙ্ক্ষায়
যে ধৃতি, কর্তব্য (ধর্ম), রোজগার (অর্থ), এবং কামের সঙ্গে গভীর আসক্তি রাখে তাকে
বলে রাজসিক ধৃতি। (18.34)
হে ধৃতির মাধ্যমে একজন মূঢ় ব্যক্তি স্বপ্ন, ভয়, শোক, বিষাদ, মদ ইত্যাদিকে
ত্যাগ করেনা সেই ধৃতিই তামসিক ধৃতি। (18.35) এবার
আমার থেকে তিন ধরণের সুখের কথা শোনো হে অর্জুন। আধ্যাত্মিক চর্চার মাধ্যমে যে সুখ
প্রাপ্ত হয় তা সমস্ত দুঃখ নাশ করে। (18.36) যে সুখ প্রথমে বিষের মতো বোধ হয়, পরিনামে
অমৃততুল্য হয়, আত্ম-জ্ঞান থেকে উৎপন্ন হয় তাকে
সাত্ত্বিক সুখ বলে। (18.37)
যে ইন্দ্রিয় সুখ প্রথমে অমৃতের মতো
বোধ হয়, কিন্তু
শেষে গিয়ে বিষের মতো লাগে, সেই সুখকে রাজসিক সুখ বলে। (এছাড়াও দেখুন 5.22) (18.38) যে সুখ
শুরুতে ব্যক্তিকে বিভ্রান্ত করে এবং শেষ পর্যন্ত ঘুম, আলস্য এবং প্রমাদে
রূপান্তরিত হয়, তাকে তামসিক সুখ বলে। (18.39) পৃথিবী অথবা দেবতাদের মধ্যে এমন কোন জীব
নেই যারা জড় প্রকৃতির এই তিন গুণ থেকে মুক্ত থাকতে পারে। (18.40) শ্রমের বিভাজন একের দক্ষতার উপর নির্ভরশীল হে
অর্জুন, মানুষের সহজাত গুণাবলীর (বা প্রাকৃতিক প্রবণতা এবং জন্মসুত্রে পাওয়া অধিকার হিসাবে
নয়) উপর ভিত্তি করে
চারটি বর্নে তাদের কে ভাগ করা হয়েছে --- ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, এবং শূদ্র। (এছাড়াও দেখুন 4.13) (18.41) হে ব্যক্তির
নির্মলতা, আত্ম-নিয়ন্ত্রন, কঠোরতা, বিশুদ্ধতা, ধৈর্য, সততা, অতীন্দ্রিয় জ্ঞান,
অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞিতা, ভগবানে বিশ্বাস আছে তাকে বলা হয় ব্রাহ্মন। (18.42) যে ব্যক্তির
শৌর্য, তেজ, ধৃতি, দক্ষতা, যুদ্ধে অটলতা, দান, এবং শাসন ক্ষমতা প্রভৃতি গুণগুলি
আছে, তাকে বলা হয় ক্ষত্রিয় অথবা অভিভাবক। (18.43) কৃষি, পশুপালন, ব্যবসা, বানিজ্য, এবং
শিল্পতে যারা উৎকৃষ্ট তাদেরকে
বৈশ্য বলা হয়। যারা সেবা এবং মজুর ধরণের কাজে উৎকৃষ্ট তাদের বলা হয় শূদ্র। (18.44) কর্তব্য, শৃঙ্খলা, এবং ভক্তির মাধ্যমে মুক্তি প্রাপ্ত করা মানুষ
নিজের স্বাভাবিক কাজে রত হয়ে সিদ্ধি লাভ করতে পারে। আমার কথা শোনো যে কিভাবে মানুষ
নিজের স্বাভাবিক কাজে রত হয়ে সিদ্ধি লাভ করে। (18.45) One
যে পরমেশ্বর ভগবান
থেকে সমস্ত জীবের সৃষ্টি এবং যে পরমেশ্বর সমগ্র জগতে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে সেই
পরমেশ্বরের তপস্যা দ্বারা সিদ্ধি লাভ করা যায়, শুধুমাত্র জীবের স্বাভাবিক কাজ সেই
ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে করে। (এছাড়াও দেখুন 9.27, 12.10) (18.46) উত্তমরূপে
অনুষ্ঠিত পরধর্মের থেকে সম্যকরূপে অনুষ্ঠিত স্বধর্ম শ্রেয়। জীব যখন তার সহজাত
স্বভাবজাত কর্ম (ফলের আসক্তি বিহীন হয়ে) সম্পাদন করে তখন সে কোন পাপের ভাগী হয় না
(অথবা কর্মফলের প্রতিক্রিয়া প্রাপ্ত করেনা)। (এছাড়াও দেখুন 3.35) (18.47) হে অর্জুন, দোষযুক্ত হলেও একজনের
স্বাভাবিক কাজ কখনও ত্যাগ করা উচিৎ নয়, কারণ সমস্ত কাজ
দোষযুক্ত থাকে, ঠিক যেমন অগ্নি ধূমযুক্ত থাকে। (18.48) যে ব্যক্তির মন সর্বদা স্বার্থপর
আসক্তিমুক্ত, যিনি মন
এবং ইন্দ্রিয়কে বশীভূত করেছেন, এবং যিনি কাম থেকে মুক্ত, তিনি কর্মের ফলের প্রতি
স্বার্থযুক্ত আসক্তি ত্যাগ করে কর্মফলের বন্ধন থেকে মুক্ত করে পারে এবং সিদ্ধিলাভ
করতে পারেন। (18.49) হে অর্জুন, আমার থেকে সংক্ষেপে শোনো, কিভাবে জীব সিদ্ধি লাভ
করতে পারে (অথবা
কর্মফলের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে) পরমেশ্বরকে প্রাপ্ত করতে পারে, অতীন্দ্রিয় জ্ঞানের
লক্ষ্য পূরণ করতে পারে। (18.50)
বিশুদ্ধ বুদ্ধিযুক্ত হয়ে, মনকে ধৃতির
দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করে, শব্দ আদি ইন্দ্রিয় বিষয় পরিত্যাগ করে,
ভালোলাগা খারাপলাগা বর্জন করে;
নির্জন স্থানে বাস করে;
স্বল্প আহার করে;
দেহ, মন, এবং বাক সংযত করে;
সর্বদা ধ্যানযোগে যুক্ত হয়ে;
বৈরাগ্য আশ্রয় করে;
এবং অহংকার, হিংসা, দর্প, কাম, ক্রোধ,
পরিগ্রহ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে --- মানুষ “আমি” এবং “আমার” ধারনা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত
হয়ে ওঠে, এবং পরমেশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।
(18.51-53) পরমেশ্বরের চিন্তায় মগ্ন থেকে, শান্ত প্রাণ সুখ বা দুঃখ বোধ
করেন না। সমস্ত প্রাণীর প্রতি উদাসীন হয়ে, মানুষ আমার পরা-ভক্তি লাভ করে, যা
সর্বোচ্চ ভক্তিমুলক প্রেম। (18.54) ভক্তির দ্বারা
মানুষ প্রকৃতই বুঝতে পারে আমি কে এবং আমার সত্ত্বা কি। আমাকে যথাযথভাবে জানার
কারণে, মানুষ অবিলম্বে আমার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। (এছাড়াও দেখুন 5.19) (18.55) সমস্ত কর্তব্য পালন করাকালীন শুধুমাত্র আমার মধ্যে আশ্রয়
নিয়ে (সমস্ত কার্য আমার প্রেমপূর্ণ ভক্তিতে সমর্পণ করে) একজন কর্মযোগী ভক্ত মোক্ষ
প্রাপ্ত হয়। (18.56) আন্তরিকভাবে তোমার সমস্ত কর্ম আমার সমর্পণ করো,
আমাকে পরম লক্ষ্য হিসাবে স্থির করো,
এবং সম্পূর্ণভাবে আমার উপর নির্ভরশীল হও। সর্বদা মন আমাতে আবদ্ধ রাখো এবং কর্মযোগ
পালন করো। (18.57) যখন তোমার মন আমার চিন্তায় মগ্ন
থাকে, তুমি আমার আশীর্বাদে সমস্ত সমস্যা অতিক্রম করবে। কিন্তু যদি অহং কারণবশত
আমার কথা না শোন, তুমি বিনষ্ট হবে। (18.58) কর্মফলের বন্ধন এবং স্বাধীন ইচ্ছা যদি তুমি
অহংবশত মনে করো: আমি
যুদ্ধ করবো না, তোমার সংকল্প নিরর্থক হবে। কারণ তোমার স্বভাব তোমাকে যুদ্ধ করতে
বাধ্য করবে। (18.59) হে
অর্জুন, তোমার কর্মফলের প্রভাবে সৃষ্ট প্রকৃতি বা স্বভাব (বা সংস্কার) দ্বারা তুমি
নিয়ন্ত্রিত। অতএব, তোমার ইচ্ছা না থাকলেও তুমি তাই করবে, যা এখন বিভ্রান্তি বশত
তুমি করতে চাইছ না। (18.60)
হে অর্জুন, পরমেশ্বর ভগবান কৃষ্ণ,
সমস্ত মানুষের হৃদয়ে উপস্থিত থেকে তাদেরকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেন (অথবা তাদের কর্মফল ব্যয় করেন)
ঠিক যেমন একটি যন্ত্রে আরূঢ় একটি
পুতুল (কর্মফলের হাতে)। (18.61) হে অর্জুন,
পরমেশ্বর ভগবানের কাছে আশ্রয় নাও প্রেমপূর্ণ ভক্তি সহকারে। তার দয়ায় আপনি সর্বোচ্চ
শান্তি এবং চিরস্থায়ী আশ্রয় পাবেন। (18.62) এইভাবে, আমি সেই জ্ঞান তোমার কাছে ব্যাখ্যা করেছি যা গোপনের থেকেও অনেক গোপন। এটি নিয়ে
সম্পূর্ণ চিন্তা করার পরে, তোমার যা মনে হয় করো। (18.63) সমর্পণের পথ, ভগবানের কাছে যাওয়ার চরম পথ আরেকবার
করে আমার সবচেয়ে গোপনীয় জ্ঞান তোমায় জানাচ্ছি, শোনো। তুমি আমার খুবই প্রিয়; তাই
তোমার হিতার্থে আমি এটি তোমায় জানাবো। (18.64) তোমার মন আমাতে আবদ্ধ করো, আমার প্রতি
সমর্পিত থাকো, আমায় সেবা করো, আমায় প্রণাম করো, এবং অবশ্যই তুমি আমায় পাবে। আমি
সত্য প্রতিজ্ঞা করছি কারণ তুমি আমার খুবই প্রিয় বন্ধু। (18.65) সমস্ত কর্ম (কারকতা, মালিকানা, এবং কর্মের ফলের প্রতি আসক্তি)
সরিয়ে রেখে,
শুধুমাত্র আমাতে সমর্পণ করো, এবং
আনন্দের সঙ্গে আমার ইচ্ছা মেনে চলো। আমি তোমায় (সমস্ত পাপ এবং কর্মফলের সমস্ত বন্ধন থেকে) মুক্ত করবো। দুঃখ করো না। (18.66)
সমস্ত কর্তব্য সরিয়ে রেখে ভগবানের
আশ্রয় নেওয়ার অর্থ জীবের উচিৎ স্বার্থযুক্ত আসক্তি
ছাড়া এবং ফলাফল ভগবানকে অর্পণ করে কাজ সম্পূর্ণ করা, সাহায্য এবং
পথপ্রদর্শনের জন্য সম্পূর্ণভাবে ভগবানের উপর নির্ভরশীল হওয়া। ভগবান এমন মানুষের
সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেন যিনি সম্পূর্ণভাবে তাঁর উপর নির্ভরশীল হন আত্মরিক
আত্ম-সমর্পণের মাধ্যমে। ভগবানের জন্য করা সর্বোচ্চ সেবা, এবং সবচেয়ে ভালো দান যারা
তপস্যা করেনা, তাদের শ্রদ্ধা নেই, যারা শোনার ইচ্ছা রাখে না, অথবা যারা আমার
দুর্নাম করে তাদেরকে কখনও এই জ্ঞান প্রদান করবে না। (18.67) যিনি আমার এই পরম গোপনীয় জ্ঞান (গীতায় বর্ণিত) আমার ভক্তদের
মধ্যে বিতরণ করবেন (বা বিতরণ করতে সাহায্য করবেন), তিনি আমার প্রতি শ্রেষ্ঠ সেবা করবেন এবং অবশ্যই তিনি
আমাকে প্রাপ্ত করবেন (পরম লোকে স্থান পাবেন)। (18.68) অন্য
কেউ আমাকে খুশী করার জন্য এর থেকে ভালো কিছু করবে না, এবং পৃথিবীতে অন্য কেউ আমার
কাছে এর থেকে বেশী প্রিয় হবে না। (18.69) যে
ব্যক্তি আমাদের এই পবিত্র কথোপকথন অধ্যয়ন করছেন, তিনি জ্ঞান যজ্ঞের মাধ্যমে আমার
পূজা করছেন। এটি আমার সত্য প্রতিজ্ঞা। (18.70) অসূয়াশুন্য যে ব্যক্তি শ্রদ্ধা সহকারে এই
পবিত্র কথোপকথন শ্রবণ করেন তিনি পাপ মুক্ত হন, এবং স্বর্গগামী হন --- সেই উচ্চতর লোক
যেখানে পবিত্র এবং ধার্মিক কর্ম সম্পন্ন মানুষেরা গমন করে। (18.71) হে অর্জুন, তুমি
কি একনিষ্ঠ মন নিয়ে এটি শুনেছ? অজ্ঞতার কারণে তোমার মধ্যে যে বিভ্রান্তি জন্মেছিল
তা কি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে? (18.72) অর্জুন বললেন: আপনার আশীর্বাদে আমার বিভ্রান্তি নষ্ট হয়েছে; আমি আত্ম-জ্ঞান
প্রাপ্ত করেছি; আমার সংশয়
(শরীর এবং আত্মা
সংক্রান্ত) দূরীভূত
হয়েছে; এবং আমি
আপনার আদেশ পালন করবো। (18.73)
সঞ্জয় বললেন: এইভাবে
আমি প্রভু কৃষ্ণ এবং মহাত্মা অর্জুনের মধ্যের আশ্চর্য কথোপকথন শ্রবণ করে রোমাঞ্চিত
হলাম। (18.74) ঋষি
ব্যাসের (গুরু) কৃপায়, আমি এই গোপনীয় যোগের উপদেশ স্বয়ং যোগেশ্বর কৃষ্ণের থেকে
শুনেছি, যখন তিনি
বলছিলেন (অর্জুন
কে) আমার
চোখের সামনে (ঋষি
ব্যাস তাকে দূরদৃষ্টি প্রদান করেন)। (18.75) হে রাজন, প্রভু কৃষ্ণ এবং অর্জুনের মধ্যে এই পবিত্র কথোপকথন
বারংবার স্মরণ করে, আমি
প্রতি মুহূর্তে রোমাঞ্চিত হচ্ছি এবং (18.76) হে রাজন, শ্রীকৃষ্ণের সেই অদ্ভুত রূপ
স্মরণ করে আমি বিস্ময়াভিভূত হচ্ছি এবং বারংবার হর্ষিত হচ্ছি। (18.77) যেখানেই
কৃষ্ণ, যোগেশ্বর (অথবা ধর্মের ঈশ্বর যেমন শাস্ত্রে বর্ণিত আছে) ভগবান এবং অর্জুন
থাকবেন কর্তব্য এবং সুরক্ষার অস্ত্র সহ, সেখানে চিরস্থায়ী সমৃদ্ধি, বিজয়, সুখ, এবং
নৈতিকতা বজায় থাকবে। এই আমার প্রত্যয়। (18.78) অতএব ভগবদ-গীতা শেষ হল এই
বই ভগবান শ্রী কৃষ্ণকে অর্পণ করা হল। তিনি
আমাদের সবাইকে সাত্ত্বিকতা, সমৃদ্ধি, এবং শান্তি দিন ওম তৎ সৎ Translated from English by: (Monica DuttaChoudhury) |